Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইসলামে শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার

ইসলামে শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার

।। ড. মাওলানা শোয়াইব আহমদ।।

শ্রম এবং শ্রমিকের ব্যাপারে বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ মহানবীর (সা.) সবচেয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত ঘোষণাটি হলো- আল কাসিবু হাবিবুল্লাহ। অর্থাৎ শ্রমিক হচ্ছে মহান আল্লাহর বন্ধু। আমরা রাসুলকে (সা.) আল্লাহর হাবিব বা বন্ধু হিসেবে জানি। অথচ মহানবী (সা.) একজন শ্রমিককে তার শ্রমের মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে তাকে মহান আল্লাহর বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাসুলের (সা.) অপর তাগিদটি হলো শ্রমিকের প্রাপ্যতা নিয়ে। তিনি বলেন- শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করে দাও। মহানবীর (সা.) উপরোল্লিখিত দুটি বাণীতে শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি অভূতপূর্ব স্বীকৃতি পেয়েছে।

এ বাণীদ্বয়ের আলোকে যদি বিশ্ব শ্রম ব্যবস্থা প্রবর্তিত হতো, তাহলে ১৮৮৬ সালের ১ মে তারিখে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিক ও শ্রম-ইতিহাসের মর্মন্তুদ ঘটনার সৃষ্টি হতো না। শ্রমিকের অধিকার ও শ্রমের মর্যাদা সংক্রান্ত ইসলামী নির্দেশনা বিশ্ববাসীর জন্যই অনুসরণীয় ও কল্যাণকর। ইসলাম শ্রমের বিষয়ে শুধু নির্দেশনা প্রদান করেই দায়িত্ব শেষ করেনি; বরং মহানবী (সা.) তাঁর বরকতপূর্ণ জীবনে শ্রমের বাস্তবায়ন ঘটিয়েও এ বিষয়ে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

বস্তুত ইসলাম কালজয়ী ও শাশ্বত এক জীবন ব্যস্থার নাম। মানুষের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষার পুরো নিশ্চয়তা বিধান করেছে ইসলাম। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে যে উপকরণটি সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক সেটি হচ্ছে শ্রম; আর নিরলস শ্রমের পরাকাষ্ঠা যারা বহন করেন তারাই শ্রমিক। ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা যথাযথভাবে স্বীকৃত। ইবনে মাজাহ শরিফের হাদিসে এসেছে- রাসুল (সা.) ওফাতকালে যে উপদেশ প্রদান করেছেন তা হলো, তোমরা নামাজ এবং অধীনদের ব্যাপারে সাবধান থেকো। এখানে অধীন বলতে কাজের লোক বা শ্রমিক, যারা কারও অধীনে শ্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আঞ্জাম দিয়ে থাকেন।

আরও পড়তে পারেন-

শ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক বিষয় খুবই প্রাসঙ্গিক। আর তা হলো, মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত নবী-রাসুলদের প্রায় সবাই প্রত্যক্ষভাবে এই শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুসনাদে আহমাদ শরিফের মতে, সব নবী-রাসুলই মেষ চরিয়েছেন; এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেও মেষ চরাতেন। বুখারি শরিফের হাদিস মতে, কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে কারও বোঝা বহন করে রোজগার করা অনেক উত্তম। কেউ কিছু দিক আর না দিক, কারও কাছে কিছু চাওয়া অপেক্ষা নিজ পিঠে করে কাঠের বোঝা নিয়ে বাজারে বিক্রি করা অনেক ভালো।

এখানেও সেই শ্রমেরই গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। দুনিয়াখ্যাত ইসলামী পণ্ডিতরা নিজেদের নামের সঙ্গে আত্তার বা আতর ব্যবসায়ী, খাব্বাজ বা রুটি ব্যবসায়ী, কাত্তান বা তুলা উৎপাদনকারী প্রভৃতি পেশাভিত্তিক উপাধি ধারণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আবু দাউদ শরিফের হাদিস মতে, যে ব্যক্তি আয়-রোজগারের জন্য শ্রম ব্যয় করে, সে যেন আল্লাহর পথে জিহাদে মত্ত। কেউ যদি তার সন্তান বা স্ত্রী অথবা বাবা-মায়ের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকে, তবে সে নিঃসন্দেহে আল্লাহর পথেই বিচরণ করছে। তাবরানি শরিফের মতে, ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় যে শ্রমিক সন্ধ্যা যাপন করে, সে নিঃসন্দেহে যাবতীয় অপরাধ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে সন্ধ্যা অতিক্রম করল। একজন শ্রমিকের জন্য এটি সর্বোত্তম এক প্রণোদনা, যা ইসলাম তাকে দিয়েছে।

বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ সুহৃদ মুহাম্মদ (সা.) নিজেকে শ্রমিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে পৃথিবীর সব শ্রমিককে ধন্য ও মর্যাদাশীল করেছেন। তিনি তাঁর প্রিয়তমা কন্যা ফাতেমাকে একজন উত্তম শ্রমিকের কাছে পাত্রস্থ করেছিলেন; যিনি শিক্ষা ও বীরত্বের দিক থেকেও ছিলেন সমান পারদর্শী। আমিরুল মোমেনিন হজরত আলি (রা.) নিজে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে শ্রমিকের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। রাসুলের (সা.) সবচেয়ে প্রিয় সাহাবি হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। নবী দাউদ (আ.) নিজেই শ্রমের বিনিময়ে তাঁর জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাসুলের (সা.) ঘোষণা- সেই খাবার সর্বোত্তম, যা স্বহস্তে অর্জিত। বুখারি শরিফের ভাষ্যমতে, রাসুল (সা.) কিয়ামতের দিবসে যাদের প্রতিপক্ষ হবেন তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো, যারা শ্রমিক নিয়োগ করবে এবং শ্রমিকের দ্বারা ষোলআনা কার্যসিদ্ধি করে নেবে; কিন্তু শ্রমিককে তার প্রাপ্র্য মজুরি দেবে না। আর রাসুল (সা.) যার বা যাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে সাব্যস্ত করবেন তাদের অবস্থা বা পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

এখানে রাসুলের (সা.) একজন প্রিয় সাহাবি হজরত আবু মাসউদের (রা.) জীবনের একটি ঘটনার অবতারণা করা যায়। মুসলিম শরিফে বিবৃত আছে, আবু মাসউদ একদিন তার এক শ্রমিককে মারধর করেন। এরই মধ্যে তিনি শুনতে পান, হে আবু মাসউদ! তোমার শ্রমিকের ওপর তোমার যতটা ক্ষমতা আর প্রভাব রয়েছে, তোমার ওপরে তোমার প্রভুর তার চেয়েও বেশি ক্ষমতা ও প্রভাব রয়েছে। মাসউদ (রা.) পেছন ফিরে দেখেন তিনি আর কেউ নন; মানবতার পরম সুহৃদ, দয়ার নবী মুহাম্মদ (সা.)। মাসউদ (রা.) খুবই লজ্জিত হলেন এবং অধীন সেই শ্রমিককে মুক্ত করে দিলেন। দয়াল নবী (সা.) বললেন, তুমি যদি একে আজাদ না করতে তবে তুমি নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে প্রজ্ব্বলিত হতে। শ্রমিকবান্ধব এমন মহাপুরুষ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আবু দাউদ শরিফের হাদিস মতে, শ্রমিকের কোনো অপরাধ হলে তা ক্ষমা করে দিতে হবে।

এক সাহাবি জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে রাসুল (সা.)! শ্রমিকের অপরাধ কয়বার ক্ষমা করব? রাসুল (সা.) চুপ থাকলেন। আবারও তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, রাসুল (সা.) আবারও চুপ থাকলেন। তৃতীয়বার যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, শ্রমিককে কয়বার ক্ষমা করব? রাসুল (সা.) গাম্ভীর্যের সঙ্গে তখন ঘোষণা করলেন, শ্রমিক যদি দিনে ৭০ বারও অপরাধ করে, তবে প্রতিবারই তাকে ক্ষমা করে দাও। পাশাপাশি রাসুল (সা.) শ্রমিকের ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছেন, শ্রমিক যেন তার মালিকের কাজে কোনো ফাঁকি না দেয়। বরং রাসুল (সা.) বলেন, সেই শ্রমিক উত্তম, যে তার মালিকের কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে থাকে।

তিনি আরও বলেন, যে শ্রমিক তার মালিকের হক আদায় করবে এবং আল্লাহর হকও আদায় করবে, মহান আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন। কাজে ফাঁকি দিয়ে অথবা শুধু হাজিরা দিয়ে কাজ না করে যে শ্রমিক মজুরি গ্রহণ করবে, সে নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ করল। এ জন্য তার জবাবদিহি করতে হবে এবং কিয়ামতের দিন তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।

পবিত্র কুরআনের বাণী অনুযায়ী ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। সুতরাং শ্রম-ঘণ্টা তথা শ্রমিকের কাজের সময়সীমার ব্যাপারেও সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন থাকার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কোনোমতেই অধিক পরিশ্রম বা অধিক সময়ের শ্রম কোনো শ্রমিকের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া ইসলামসম্মত নয়।

কুরআনে কারিমে মানুষকে চিত্রিত করা হয়েছে শ্রমের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য দিয়ে। ইরশাদ হচ্ছে- সুনিশ্চিতভাবে মানুষকে আমি শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি। এই শ্রমনির্ভরতা বা শ্রমিকের বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সব মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। সুতরাং শ্রম ও শ্রমিকের পেশাটি একটি সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। সে জন্য যে কোনো শ্রমকেই আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় সম্ভাব্য সব প্রচেষ্টাই একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি-রাষ্ট্রের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হওয়া আবশ্যক।

লেখক: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক এবং যুগ্মমহাসচিব- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।