Home ইসলাম ঈদ-উল-ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ঈদ-উল-ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

।। মাওলানা শোয়াইব জমিরী ।।

ঈদুল ফিতর’ কথাটি আরবি। ‘ঈদ’ মানে আনন্দ–উৎসব; যা বারবার ফিরে আসে প্রতিবছর। রমজানের রোজার শেষে এ ঈদ আসে বলে এর নাম ‘ঈদুল ফিতর’। বাংলায় আমরা বলি রোজার ঈদ। মুসলিম মিল্লাতের দুটি ঈদের একটি ঈদুল ফিতর। সুতরাং ঈদুল ফিতর বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহা উৎসবঈদ শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দিবসে তাঁর বান্দাদেরকে নিয়ামাত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন ও তাঁর দয়ার দৃষ্টি দান করেন।

ইসলামি শরীয়তে ঈদের প্রচলন

আল্লাহ রাববুল আলামিন মুমিন মুসলমানদের প্রতি নিয়ামাত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা শরীফ হিজরতের পর প্রথম হিজরীতেই শুরু হয় ঈদ । পূর্বেকার নবীদের সময় ঈদের প্রচলন ছিল না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা শরীফ হতে হিজরত করে যখন মদিনা শরীফ পৌঁছলেন তখন মদিনাবাসীরা নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামে দু’টি আনন্দ দিবস উদযাপন করতে দেখলেন, যে দিবসগুলোতে তারা শুধু খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তি করে। হযরত আনাস রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দু’দিনের কী তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসীগণ উত্তর দিলেন- আমরা জাহেলী যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বললেন : ‘আল্লাহ রাববুল আলামিন এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দু’টো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আদ্বহা ও ঈদুল ফিতর।’ (সুনান আবূ দাউদ- ১১৩৪)।

হাদিস শরীফের আলোকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে ঈদের প্রকৃত অর্থ শুধু দামী, রঙ্গিন জামা, হরেক রকম মুখরোচক খাবার আর নানা ধরণের খেলাধুলা এবং আনন্দ-উৎসবের নাম-ই ঈদ নয়। ধনী গরীবের এক কাতারে নামাজে দাড়ানো শুধু ঈদ নয় বরং তাদের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনাও ঈদের উদ্দেশ্য ঈদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

“আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্যে তোমরা আল্লাহর মমত্ব-বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞ হও।” (সূরা বাকারা- ১৮৫)।

এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, ঈদের উদ্দেশ্য হল- (১) আল্লাহর বড়ত্ব মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা। (২) আল্লাহ যে নেয়ামত দান করেছেন তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা।

আমাদেরকে আল্লাহর বিধান এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত অনুসরণে ঈদ উদযাপন করতে হবে। ঈদুল ফিতরে নবী সা. আমাদের জন্য কি কর্মসুচি দিয়েছেন সেটা আমাদেরকে জানতে হবে। কারণ, ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামাত। এ দিনে অনেক কাজ আছে যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদাতে পরিণত হতে পারে।

ঈদের দিনে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা

একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানো, অভিবাদন জানানো মানুষের সুন্দর চরিত্রের একটি দিক। এতে খারাপ কিছু নেই; বরং এর মাধ্যমে একে অপরের জন্য কল্যাণ কামনা ও দোয়া করা হয়। পরস্পরের মাঝে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়।

ঈদ উপলক্ষে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন-

(ক) হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন ‘যুবাইর ইবনে নফীর থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَم (তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম)। অর্থ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। (ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী ৬/২৩৯, আসসুনানুল কুবরা লিলবাইহাকী, হাদীস- ৬৫২১)।

(খ) প্রতি বছরই আপনারা সুখে থাকুন, ) كل عام وانتم بخير কুল্লা আমিন ওয়া আনতুম বিখাইর ( বলা যায়।

এ ধরনের সকল মার্জিত বাক্য দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। তবে প্রথমোক্ত বাক্য تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَم দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময় করা উত্তম। কারণ সাহাবায়ে কিরাম রা. এবং তাবিয়ীনে কেরাম ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে এ বাক্য ব্যবহার করতেন। এতে পরস্পরের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট দোয়া-প্রার্থানা রয়েছে। ঈদের দিনে ঈদ মোবারক বলে শুভকামনা প্রকাশ করা যদিও বিধিসম্মত কিন্তু তা আজ প্রথাসর্বস্ব রীতির রূপ পরিগ্রহ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সালামের পরিবর্তে প্রচলিত এ সম্ভাষণটি ব্যবহার করা হয়। অথচ সাক্ষাৎ হলে প্রথমে সালাম করবে। তারপর অন্য সম্বোধন। তাই তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম কেই ঈদের দিনের সম্ভাষণ রীতি হিসেবে গ্রহণ করা সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি। তবে ঈদুল ফিতরের সম্ভাষণ প্রাপ্তির শ্রেষ্ঠ উপযুক্ত ব্যক্তি তো তাঁরাই যাঁরা রমাযানুল মুবারাকে রোযা রেখেছে। পবিত্র কুরআনের দিকনির্দেশনা থেকে বেশি বেশি উপকৃত হয়েছে। তাকওয়া ও খোদাভীতির দীক্ষা গ্রহণ করে পুরো বছর দীনের উপর অবিচল থাকার অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে।

ঈদের দিনের সুন্নাহসম্মত আমল

১. ঈদের দিন গোসল করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা

ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা মুস্তাহাব। কারণ এ দিনে সকল মানুষ নামায আদায়ের জন্য মিলিত হয়। ইবনে উমর রা. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, তিনি ঈদুল-ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। (মুআত্তা ইমাম মালেক ১/১৭৭)।

সায়ীদ ইবনে মুসাইয়াব রহ. বলেন, ঈদুল ফিতরের সুন্নত তিনটি-
১। ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।
২। ঈদগাহের দিকে যাত্রা করার পূর্বে কিছু আহার করা।
৩। গোসল করা। (ইরওয়াউল গালীল ৩/১০৭)।
তদ্রূপ সুগন্ধি ব্যবহার করা ও উত্তম পোশাক পরিধান করাও মুস্তাহাব।

ইবনে উমর রা. থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত,তিনি দু’ঈদের দিনে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। (ফাতহুল বারী- ২/৫১০)।

ইমাম মালেক রহ. বলেন, আমি উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে শুনেছি, তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার ও সাজসজ্জাকে মুস্তাহাব বলেছেন। (আলমুগনী লিইবনে কুদামা ঈদ অধ্যায় ফাতহুল বারী- ২/৫১০)।

২. ঈদের দিনে খাবার গ্রহণ প্রসঙ্গ

সুন্নত হলো ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের নামায আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা। আর ঈদুল আজহা-তে সুন্নাত হলো ঈদের নামাযের পূর্বে কিছু না খেয়ে নামায আদায়ের পর কোরবানির গোশত দ্বারা আহার গ্রহণ করা।

বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে কিছু না খেয়ে বের হতেন না। আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের নামাযের পূর্বে কিছু খেতেন না। নামায থেকে ফিরে এসে কোরবানির গোশত দ্বারা আহার গ্রহণ করতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস- ১৪২২)।

আরও পড়তে পারেন-

৩. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া।

আগে আগে ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া উত্তম। যাতে ইমাম সাহেবের নিকটবর্তী স্থানে বসা যায় ও ভালো কাজ দ্রুত করার সওয়াব অর্জন করা যায় এবং নামাযের অপেক্ষায় থাকার সওয়াব লাভ করা যায়।

আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সুন্নত হলো ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। (সুনানুত তিরমিযী হাদীস নং ৪৩৭, বাদাইউস সানায়ে’ ১/৬২৫)।

৪। ঈদগাহের যাতায়াত পথ পরিবর্তন করা।
সুন্নত হলো যে পথে ঈদগাহে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা।

হযরত জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে যাতায়াতের পথ পরিবর্তন করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ৯৮৬)।

৫. ঈদের তাকবীর আদায়।
ঈদগাহে যাওয়ার পথে তাকবীর পাঠ করা মুস্তাহাব।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। ঈদের নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। যখন নামায শেষ হয়ে যেত তখন আর তাকবীর পাঠ করতেন না। (সুনানে দারা কুতনী- ২/৩৪)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইবনে উমর রাযি. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে ঈদগাহে আসা পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করতেন। ঈদগাহে এসে ইমামের আগমন পর্যন্ত এভাবে তাকবীর পাঠ করতেন। (সুনানে দারাকুতনী ২/৩৩; আসসুনানুল কুবরা লিলবাইহাকী ৩/২৭৯)।

ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ রহ. বলেন, ঈদুল ফিতরের সময় সশব্দে তাকবীর পাঠ করা উত্তম। ইবনে উমর রা., আলী রা., আবু উমামা রহ.সহ বহু সাহাবা তাবিয়ী রা. ঈদুল ফিতরের সময়ও সশব্দে তাকবীর পাঠ করতেন। (গুনয়াতুল মুতামাল্লী ৫৬৭, হাশিয়াতু তাহতাবী আলাদ্দুর ১/৩৫৩, বাদায়িউস সানায়ি- ১৬২৫)।

এক নজরে ঈদের সুন্নাতসমূহ

  • অন্য দিনের তুলনায়  আগে আগে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। (সুনানে বাইহাকী কুবরা, হাদীস ৬১২৬)।
  • ভালভাবে গোসল করা। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩১৫)।
  • শরীয়তসম্মত সাজসজ্জা গ্রহণ করা। (বুখারী শরীফ ৯৪৮)।
  • সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম ও পরিষ্কার পোশাক পরিধান করা। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৪৮)
  • সুগন্ধি ব্যবহার
  • ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় আহার (যেমন খেজুর) গ্রহণ করা। তবে ঈদুল আজহাতে কিছু না খেয়ে নিজের কোরবানীর গোশ্ত দ্বারা আহার গ্রহণ করা উত্তম। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৫৩)
  • সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া। (সুনানে আবূ দাঊদ, হাদীস ১১৫৭)
  • ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিত্র আদায় করা। (সুনানে দারা কুতনী, হাদীস ১৬৯৪)
  • ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা, বিনা অপারগতায় মসজিদে আদায় না করা। (সহীহ বুখারী, হাদসি ৯৫৬)
  • সম্ভব হলে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ থেকে ফিরে আসা। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৮৬)
  • পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। (সুনানে আবূ দাঊদ, হাদীস ১১৪৩)
  • ঈদগাহে যাওয়ার সময় নিম্নোক্ত তাকবীর পাঠ করা- اَللهُ َكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ، لَاإِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ وَلِلهِ الحَمْدُ (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।)।

শেষ কথা: ঈদুল ফিতর শান্তি ও কৃতজ্ঞতা, ক্ষমা ও নৈতিকতা, পুণ্য ও সাফল্য, স্মরণ ও নির্মল বিনোদনের এক অনন্য বার্তা বহন করে থাকে। ঈদুল ফিতরের নির্মল আনন্দে মুখরিত হোক মুমিন জীবনের দিক দিগন্ত। মুছে যাক অতীতের যাবতীয় গ্লানী। আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হোক চারিধার। আল্লাহ আমাদের সকলকে নির্মল আনন্দের পবিত্র আবহে ঈদুল ফিতর উদযাপন করার সৌভাগ্য দান করুন। আমিন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।