Home ফিকহ ও মাসায়েল প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান-৫

প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান-৫

।। আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুচ্ছালাম চাটগামী ।।

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

বিয়ে বিচ্ছেদের বিচিত্র অবস্থাঃ (ক) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সদ্য প্রতিষ্ঠিত সম্পর্কটি ছুটে যাওয়া, অথবা (খ) এখন পর্যন্ত দাম্পত্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি এমন কি নির্জনবাসও হয়নি। আল বাহরুর রায়েক-এ উভয় অবস্থার হুকুম এই বর্ণনা করা হয়েছে যে, অর্থাৎ- অসমকক্ষ পরিবারে সংঘটিত বিয়ের উপর অভিভাবক আপত্তি উত্থাপন করার পর যদি বিচারক স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ করে দেয়, তাহলে দেখতে হবে এই বিচ্ছেদ মেলা-মেশার পর হয়েছে কি না? যদি এমন হয়, তাহলে মহিলা পূর্বধার্যকৃত মহরের প্রাপ্য হবে। আর ইদ্দতের ভরণ পোষণও স্বামীর উপর দেয়া জরুরী হবে। আর নির্জন বাস হলেও একই হুকুম প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে বিচ্ছেদটা যদি মেলা-মেশার পূর্বে হয়ে থাকে, তাহলে মহিলা কোন মহর পাবে না, কারণ এ বিচ্ছেদ স্বামীর পক্ষ থেকে হয়নি। বরং মহিলার অভিভাবকের পক্ষ থেকে হয়েছে। অনুরূপ “খানিয়া”তেও বলা হয়েছে।

ফাতওয়ায়ে “তাতারখানিয়ায়” বলা হয়েছে, অর্থাৎ- প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলা যদি অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত অসমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করে ফেলে, তাহলে তার অধিকার আছে যে, সে স্বামীকে মেলা-মেশা ও একসাথে থাকতে নিষেধ করার। ফাত্ওয়ায়ে ওয়াল ওয়ালিজিয়্যাতে বলা হয়েছে যে- অভিভাবক অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত সে বাধা দিতে থাকবে। আর “ফাত্ওয়ায়ে আলহাভী”তে আছে যে, শায়খ আবু বকর কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, বিয়ে সংঘটিত হয়ে গেছে, যার পর স্বামীকে মেলা-মেশা করতে বাধা দেয়ার অধিকার তার নেই। তবে অভিভাবক আদালতের দ্বারস্ত হওয়ার অধিকার রাখেন। আমাদের নিকটও তাই গ্রহণীয়। এটা জাহেরী বর্ণনার পরিপন্থী। আমাদের অনেক মাশায়েখ জাহেরুর রেওয়ায়েত এর উপর ফাত্ওয়া দিয়েছেন এবং বলেছেন, বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর স্বামীকে মেলা-মেশা না করতে দেয়ার অধিকার নেই। অস্পষ্ট নয় যে, অসমকক্ষ পরিবারে যদি কোন প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করে ফেলে, তাহলে এ বিয়ে সংঘটিত হবে, না হবে না এ-ব্যাপারে হানাফী ইমামগণের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। উভয় পক্ষের বর্ণনা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে এবং এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, উভয় বর্ণনার উপর আমাদের আকাবির এবং মাশায়েখ ফাত্ওয়া প্রদান করেছেন।

জাহেরী বর্ণনার উপর উপমহাদেশের বরেণ্য ফিকাহ্বিদ ও মুফতীগণের কতিপয় ফাতওয়াঃ

ফিক্বাহ্ ও ফাত্ওয়ার গ্রন্থাদিতে উল্লিখিত পূর্ববর্তী আকাবির ও মাশায়েখের বিবৃতির পর এবার পরবর্তী হানাফী ফিক্বাহ্বিদদের কতিপয় ফাত্ওয়াও এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে।

১। যুগশ্রেষ্ঠ ইসলামী আইনজ্ঞ সমসাময়ীক যুগের হানাফী ইমাম ইমামে রব্বানী মাওঃ রশিদ আহ্মদ (রাহ্.) অসমকক্ষ পরিবারে বিয়ে সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে লিখেনঃ অর্থাৎ- উল্লিখিত অবস্থায় অভিভাবকের বিয়ে বিচ্ছেদ করে ফেলার অধিকার থাকবে। তবে এ বিচ্ছেদের জন্য সে যেন কোন বিচারকের শরণাপন্ন হয়। হানাফী মাযহাব মতে বিচারকের ফায়সালা ছাড়া শুধু কোন মুফতীর জন্যে বিয়ে বিচ্ছেদের অধিকার নেই। -রশিদ আহমদ।

উত্তর সঠিক হয়েছে- (১) মাহমুদ (রাহ্.) (২) মানফায়ত আলী।

প্রথম উত্তর দাতার উত্তর সঠিক হয়েছে, অভিভাবকের অধিকার থাকবে যে, বিয়ে বিচ্ছেদ করে দেবার। ইতি- আজিজুর রহমান দেওবন্দী। (ফাত্ওয়ায়ে রশিদিয়া ৩৮৮ পৃঃ)।

২। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম মুফতী হযরত মাওলানা আজিজুর রহমান (রাহ্.)এর জবাবও এখানে এসে গেছে। তবে বিয়ে সংঘটিত না হওয়ার উপরও ফাত্ওয়া আছে (ফাতওয়ায়ে দারুল উলূম ৮/১৮১-১৮৫)।

৩। দারুল উলূম দেওবন্দের দ্বিতীয় ফাত্ওয়ায় হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী (রাহ্.)এর জবাব।

প্রশ্ন- নেজামুদ্দীন সাহেবের মেয়ের বয়স সে নিজে ৩০ বৎসর বলে উল্লেখ করেছে। এবং সে নিজে-নিজে বিয়ে করে ফেলেছে। তারপর তার পিতা-মাতা জোরপূর্বক অন্যত্র তাকে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, বিয়ে কোনটা শুদ্ধ হবে, প্রথমটি না দ্বিতীয়টি?

সমাধানঃ মহিলা যেহেতু প্রাপ্তবয়স্কা এবং সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন, তাই তার দ্বিতীয় বিয়ে যা পিতা-মাতা করিয়েছে, তা বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য গণ্য হবে। কারণ, কোন প্রাপ্তবয়স্কা মহিলাকে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ার অধিকার কারো নেই। এমনটি “হিদায়া” গ্রন্থেও বলা হয়েছে। আর মহিলা কর্তৃক কৃত পয়লা বিয়ে, যা সে পিতার অনুমতি ব্যতিতই করে ফেলেছে, তা যদি সমকক্ষ পরিবারে মুহরে মিছালের মাধ্যমে হয়ে থাকে, তাহলে তাই সম্পন্ন হয়ে যাবে। এখানে আর তা কেউ বিচ্ছেদ করতে পারবে না। যদি বিয়েটি অসমকক্ষ পরিবারে হয়ে থাকে, অথবা মুহরে মিছালের কমে হয়ে থাকে, তাহলে এ বিয়ে বিচ্ছেদ করে ফেলার অধিকার অভিভাবকের থাকবে নীতিগত ভাবে। তবে তার প্রক্রিয়া হল, কোন মুসলিম বিচারকের শরণাপন্ন হয়ে বিচ্ছেদের পরওয়ানা অর্জন করতে হবে। যেমন হিদায়া গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ (অর্থ-বিচ্ছেদের জন্য বিচারকের ফায়সালা লাগবে। তার পরেও অন্য কোথাও বিয়ে দিতে গেলে মেয়ের পূর্ণ সম্মতি জরুরী। সম্মতি ব্যতিত জোর করে বিয়ে দেবার অধিকার কারো নেই। (ফাত্ওয়ায়ে দারুল উলূম কামেল, নতুন এডিশন, ২/৫৩২ পৃষ্ঠা)।

৪। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রাহ্.) কর্তৃক প্রদত্ত ফাত্ওয়া।

প্রশ্নঃ বালেগ মহিলা যদি সমকক্ষ কোন ছেলেকে বিয়ে করে। কিন্তু তার শরয়ী অভিভাবকরা নিজেদের ধারণা মুতাবিক ছেলেকে সমকক্ষ মনে না করে এ বিয়ের ব্যাপারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। তাহলে অভিভাবকের অসন্তুষ্টির পরও তা শুদ্ধ হবে কি, হবে না?

সামাধানঃ অর্থাৎ- মহিলা যদি অসমকক্ষ পাত্রকে বিয়ে করে আর অভিভাবক যদি শরয়ী হয়, তাহলে সে এতে আপত্তি উত্থাপন করতে পারবে এবং বিচারকের মাধ্যমে সে তার বিচ্ছেদও ঘটাতে পারবে। ফাত্ওয়ায়ে শামীতে বলা হয়েছে, মাসআলাটি যেহেতু মত বিরোধপূর্ণ, তাই বিচারকের ফায়সালা ব্যতিত বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো সম্ভব নয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিয়েতো শুদ্ধই হয়ে গেছে, তবে অভিভাবক যদি পাত্রকে অসমকক্ষ মনে করে, তাহলে কোন মুসলিম বিচারকের নিকট মুকদ্দমা দায়ের করবে। যদি তথ্যানুসন্ধানের পর বিচারকের বুঝে আসে যে, সত্যিই সে অসমক্ষ, তবেই কেবল বিচারকের ফায়সালার মাধ্যমে তা বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে। অন্যথায় বিচ্ছেদ ঘটাবে না। (ইমদাদুল ফাত্ওয়া, ২/৩৫৭-৩৫৮)।

এছাড়াও হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী (রাহ্.) থেকে বিয়ে সংঘটিত না হওয়ার ব্যাপারেও ফাত্ওয়া আছে। এবং মুফতী আযম মুফতী আজিজুর রহমান (রাহ্.) থেকে বিয়ে সংঘটিত না হাওয়ার ব্যাপারে ফাতওয়া বর্ণিত আছে। হযরত মাওলানা মুফতী ওলি হাসান টুংকী (রাহ্.)কেও দেখেছি যে, তিনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দু’ধরণেরই ফাত্ওয়া প্রদান করতেন। কিন্তু এখানে অধমের ধারণা হয় যে, একেক বার একেক ধরণের ফাত্ওয়া না দিয়ে প্রকাশ্য বর্ণনার উপর ফাত্ওয়া দেয়া শ্রেয় হবে। তার কারণ হল- ১। প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলা, যে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত নিজ পছন্দে এবং নিজ ক্ষমতা বলে বিয়ে করেছে, সে একজন মানুুষ হিসেবে তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে তার একটা শরয়ী অধিকার আছে বিধায় তার এ বিয়ে সংঘটিত হয়ে যাবে।

২। শরীয়তের কানুন হল, যতক্ষণ পর্যন্ত শরীয়ত পরিপন্থী না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন আকেল বুদ্ধি সম্পন্ন বালেগ ব্যক্তির প্রতিটি কাজ দুরস্ত বলে বিবেচিত হবে। এ মূলনীতির আলোকে প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলার প্রত্যেক কাজ করার অধিকার আছে।

৩। প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী কর্তৃককৃত বিয়ের কাজ কুরআনের পূর্ণ মুতাবিক। সুতরাং বিয়েকে সংঘটিত বলে ধরে নিলে পবিত্র কুরআনের উপর আমল করা হবে। অন্যথায় তার বিরোধিতা হবে যেমনটি সবিস্তারে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

৪। তার এ কাজ রাসূলুল্লাহ (সা.)এর হাদিস এবং তার ফায়সালার পূর্ণ মুতাবিক। সুতরাং অসমকক্ষ পরিবারে কৃত প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলার বিয়ে সংঘটিত বলে ধরে নেয়া মানে হাদিসের উপর আমল করা। অন্যথায় হাদিসকে বর্জন করা লাগবে।

৫। যে সব আয়াত ও হাদিস থেকে মহিলাদের বিয়ের অধিকার অভিভাবকদের বলে প্রতীয়মান হয়, তা যদি আকেল বলেগের উপর হয়, তাহলে মুস্তাহাব পর্যায়ের অধিকার উদ্দেশ্য। আবশ্যকীয় পর্যায়ের নয়। সুতরাং বিয়ের আসল অধিকার প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলার হাতেই। শরীয়ত তার বিয়ের ব্যাপারে তাকেই অভিভাবক গণ্য করেছে। ফিকাহ্ গ্রন্থাদিতে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (নুতাফ-১/১৭৫, ফাতওয়ায়ে শামী আল বাদায়ে)।

৬। সমকক্ষ পরিবারে যদি কোন প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াও বিয়ে করে, তাহলে হানাফী ইমামগণের নিকট তা বৈধ এবং তা সংঘটিত হয়ে যায়। কারণ নিজের বিয়ের ব্যাপারে তার অধিকার আছে। সে নিয়মপরিপন্থী এমন কোন অপরাধ করেনি, যা বিয়ের আক্বদে প্রভাব ফেলবে। আর উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসের বিরোধীতাও সে করেনি, যেখানে অভিভাবককে অধিনস্ত মহিলাদের বিয়ে আঞ্জামদেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কারণ ঐসব আয়াতে অভিভাবকদের যে অধিকার দেয়া হয়েছে, তা মুস্তাহাব ও সৌজন্য মূলক এবং সামাজিক শালীনতা ও ভদ্রতার কারণে,  এতে বিয়ের আক্দে কোন তারতম্য ও ঊনিশ বিশ সৃষ্টি হবে না। তবে এ ধরণের বিয়ের দ্বারা মহিলা যেহেতু তার অভিভাবকের অবমূল্যায়ন ও সম্মান পরিপন্থী কাজ করেছে, তাই সে যেমন এক প্রকারের গুনাহের কাজ করল, তেমনি অভ্রদ্রতা-অশালীনতা এবং নির্লজ্জতার কাজ করল। মোটকথা সমকক্ষ পরিবারেকৃত প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলার বিয়ে সংঘটিত হয়ে যাবে। অনুরূপ ভাবে অসমকক্ষ পরিবারেও যদি বিয়ে করে, তাহলে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে বটে, তবে যেহেতু এতে অভিভাবকের অধিকারক্ষুন্ন হয়েছে, তাই অধিকার থাকবে যে, সে চাইলে আদালতের মাধ্যমে এ বিয়ে বিচ্ছেদ করে দিতে পারবে।

৭। হানাফী ইমামগণ যেমন- ইমাম আযম আবু হানিফা, ইমাম আবু ইউসূফ, ইমাম মুহাম্মদ (রাহ্.)এর মুকাল্লিদ, তারই অনুস্বরণ করা আমাদের জন্য জরুরী। তা’ছাড়া কুরআনের আয়াত এবং হাদিসে রাসূল (সা.)এর সমর্থন এতে রয়েছে।

৮। হানাফী মাযহাবের সুপ্রসিদ্ধ মতন চতুষ্টয়েও এ প্রকাশ্য বর্ণনাকে গ্রহণ করা হয়েছে।

৯। ব্যখ্যা গ্রন্থ এবং ফাতওয়া গ্রন্থাদিতে জাহেরী রেওয়ায়েত এবং নাদেরুর রেওয়ায়েত এর ভিন্নতা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, অধিকাংশ মাশায়েখ এর ফাতওয়া নাদেররু রেওয়ায়েতের উপর বর্ণিত হয়েছে। তবে অন্য কিছু সংখ্যক মাশায়েখের ফাত্ওয়া হল জাহেরী রেওয়ায়েতের উপর। যেমনটি ইতিপূর্বে আলমগীরি, তাতারখানিয়া ইত্যাদি কিতাব সমূহের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে।

১০। আমাদের আকাবির এবং মুফতিয়ানে কেরামও জাহেরী রেওয়ায়েতের উপর ফাত্ওয়া দিয়েছেন।

১১। অধম লিখকের যা ধারণা, তাহল অধিকাংশ মাশায়েখ যুগপরিবর্তনের ভিত্তিতে যে সব কারণকে সামনে রেখে নাদেরুর রেওয়ায়েতকে অবলম্বন করেছিলেন এবং জাহেরুর  রেওয়ায়েত এর বিপরীত ফাত্ওয়া প্রদান করেছিলেন, বর্তমান যুগে সে সব কারণ আর নেই। যেমন-ধরুন, পূর্বেকার যুগে আদালতের কার্যাদির ব্যাপারে জনসাধারণ অনভিজ্ঞ হত। আর এখন শুধু অভিভাবক আর মাতা পিতারাই নন, বরং খোদ প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলারাও জাগতিক জ্ঞান ব্যাপকভাবে লাভ করায় এবং আদালত সংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপারে অবগত হয়ে যাওয়ায়, এমনকি আদালতের মাধ্যমে কোর্ট ম্যারেজ করতে শুরু করেছে; যা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে- তারা আদালতের বিষয়ে পূর্ণ অবগত। তা’ছাড়া বর্তমান আদালতের বিচারকরাও ফ্যামিলিগত ব্যাপার-স্যাপারে সাধারণতঃ মহিলাদের দিকটা লক্ষ্য করে থাকেন। সুতরাং মহিলাদের উপর জুলুমের কোন আশংকা এখন তেমন একটা নেই।

১২। রয়ে গেল বিচ্ছেদের জন্যে আদালতের মধ্যস্থতা নেয়া। যদিও অভিভাবকের জন্যে এটি স্বতন্ত্র ক্ষতির কারণ, কিন্তু বিয়েকে বাতেল সাব্যস্ত করাটাও তার চেয়ে বড় ক্ষতিকর।

উদাহরণ স্বরূপ- অসমকক্ষ পরিবারে যে প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত বিয়ে করে নেয়। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, তাদের মাঝে পূর্বের গোপন সম্পর্ক বৈবাহিক ভাবে হয়ে থাকে। যদি বিয়েকে বাতেল বলা হয়, তাহলে এর ফলশ্র€তিতে তাদের ঐ পূর্বের সম্পর্ককে অবৈধ বলতে হবে এবং তাদের ঐ গোপন সম্পর্ককে যেনা ব্যাভিচার বলতে হবে। এটাতো আরো বড় ধরণের ক্ষতি। কোন কোন সময় পূর্বের এ গোপন সম্পর্কের মাধ্যমে সন্তানাদিও জন্ম লাভ করে থাকে। তখনতো এদেরকে হারাম সন্তান আখ্যা দিতে হবে। অথচ তারা তো শরীয়তের নিয়ম-কানুন মেনেই বিয়ে করেছিল। আর ঐ সম্পর্ক বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। সন্তানাদিও ছিল বৈধ। তাছাড়া ঐসম্পর্কের কারণে সে মেয়ে মহর প্রাপ্য হবে। আর একে বাতেল ঘোষণা করলে তো মহর পাবে না, তার মূল্যবান জীবনটা অহেতুক বরবাদ হবে। কাজেই অভিভাবকের ক্ষতিটাকে ক্ষুদ্র আখ্যা দিয়ে বিবাহ কে সম্পূর্ণ বলে ধরে নিতে হবে। আর এর উপর ফাত্ওয়া দেওয়াকেই সব চেয়ে নিরাপদ ও সমিচীন মনে করা হবে।

১৩। সঙ্গত কারণেই “বাদায়ে”-এর লিখক লিখেছেন।  অর্থাৎ- প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলারা বিয়েকে সম্পূর্ণ বলে ধরে নিলে যদিও অভিভাবকের ক্ষতি হয়, কিন্তু তা অসম্পন্ন ধরলে আরো বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়, যার যত কিঞ্চিৎ বর্ণনা অধম-১২নং সূত্রে উল্লেখ করেছি।

উত্থাপিত প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর-

প্রশ্ন নং ১ ও ২-এর সংক্ষেপ উত্তরঃ সাধারণ পরিস্থিতিতে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত নিজে নিজে প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী মহিলার বিয়ে মকরূহ। কিন্তু প্রশ্নে বর্ণিত অবস্থায় যখন ছেলে দ্বীনদার চরিত্রবান বংশধর পেশাগত এবং অর্থ সম্পদের দিক থেকে সমকক্ষ পরিবারে হয়, তখন বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে। আর এই অবস্থায় বিয়ের যাবতীয় হুকুম স্বামী-স্ত্রীর উপর আবর্তিত হবে।

প্রশ্ন নং ৩ এর উত্তরঃ এ ব্যাপারে কথা হল এই যে, মহিলার জন্যে সর্বপ্রথম অভিভাবককে সম্মত করা জরুরী। যদি চেষ্টা করার পরও অভিভাবক সম্মত না হয়, তাহলে স্বীয় পছন্দের ছেলের সাথে (যে নাকি দ্বীন-ধর্ম, স্বভাব-চরিত্র, বংশ-মর্যাদা, পেশা এবং অর্থ-সস্পদের দিক থেকে সমকক্ষ পরিবারের হয়) অনুমতি ব্যতিতই বিয়ে করলে তা সম্পন্ন হয়ে যাবে। আর স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপর তখন বিয়ের যাবতীয় হুকুম প্রযোজ্য হবে। বিয়ে একবার হয় যাবার পর এতে অভিভাবকের কোন প্রকারের আপত্তি উত্থাপনের অধিকার থাকবে না, বিয়ে বিচ্ছেদ করা সেতো দুরের কথা। তবে স্বামী পারিবারিক সামঞ্জস্যতার দিক দিয়ে যদি নীচ পর্যায়ের হয়, আর অভিভাবক যদি এতে সম্মত না হয়, তাহলে অভিভাবক আদালতের মাধ্যমে স্বামীর অসমকক্ষতা প্রমাণ করে বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে।

প্রশ্ন নং ৪-এর উত্তরঃ উল্লিখিত গোত্রের মাঝে একে অপরের সমকক্ষ। সুতরাং মর্যদাগত অভিন্ন গোত্রের হওয়ার কারণে তাদের মাঝে বিশেষ কোন পার্থক্য হবে না। ছেলে যদি দ্বীন-ধর্ম স্বভাব চরিত্র-পেশা এবং অর্থ-সম্পদে মেয়ের সমকক্ষ হয়, তাহলে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিতও বিয়ে সংঘটিত হয়ে যাবে। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর উপর বিয়ের যাবতীয় হুকুম আবর্তিত হবে। অভিভাবক এ বিয়ে বিচ্ছেদ করতে পারবে না। তবে যদি ছেলের অবস্থা মেয়ের তুলনায় কম হয়, তাহলে জাহেরী রেওয়ায়েত মুতাবিক বিয়ে সংঘটিত হয়ে যাবে। তবে বিয়ের পর অভিভাবকের অধিকার থাকবে বিয়ে বিচ্ছেদ করে দেবার। তবে তা হতে হবে আদালতের মধ্যস্থতায়। কারণ শরীয়তে বিয়ের ব্যাপারে স্বয়ং পাত্রী এবং তার অভিভাবক উভয়ের ইজ্জত আব্র€র প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং অন্যান্য মঙ্গলজনক দিক বিবেচনা করে সমকক্ষতাকে জরুরী সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং যদি অভিভাবক এ-বিয়েতে একমত না হন, আদালতের মধ্যস্থতায় বিয়ে বিচ্ছেদ করার অধিকার তার থাকবে।

আর যদি মহিলার মত অভিভাবকও এ অসমকক্ষ ছেলের সাথে বিয়ের ব্যাপারে সম্মত হয়ে যায়, তাহলে শরীয়ত এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।

প্রশ্ন নং ৬এর উত্তরঃ পূর্বোক্ত আলোচনায় এসে গেছে। অর্থাৎ এ সব অবস্থায় মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করতে পারবে। অভিভাবক এ ধরণের বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে না। [সমাপ্ত]

ফাত্ওয়া লেখক- মুফতিয়ে আযম আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (দা.বা.),
জবাব সঠিক: ১। মাওঃ আব্দুল মজিদ ২। বান্দা আবু বকর সাঈদুর রহমান ৩। মুহাঃ শফিক আরিফ ৪। মাওঃ এনামুল হক ৫। মাওঃ আব্দুল কাদের, ৫ই জামাদিউস্ সানি, ১৪১৮হিঃ, বিন্নুরী টাউন, পাকিস্তান।    

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

প্রথম কিস্তি পড়ুন- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

তৃতীয় কিস্তি পড়ুন- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

চতুর্থ কিস্তি পড়ুন- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান