Home ফিকহ ও মাসায়েল প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

।। মুফতিয়ে আযম আল্লামা আবদুচ্ছালাম চাটগামী ।।

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

১১। হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) বর্ণনা করেন, একবার হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর খেদমতে এক কুমারী উপস্থিত হয়ে আরয করল যে, আমার পিতা আমার অপছন্দ মতেই এক ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে এ বিয়ে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার দিয়ে দিলেন। বললেন তুমি চাইলে তা প্রত্যাখ্যান করতে পার। কারণ তোমার সম্মতি ব্যতিত বিয়ে হতে পারে না।

১২। হযরত খানসা বিনতে খিসাম আনসারী (রাযি.) বর্ণনা করেন যে, তার অসম্মতি ক্রমে তার পিতা তাকে একজন ছেলের সাথে বিয়ে করিয়ে দেয়, অথচ সে তখন প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী ছিল। হযরত খানসা (রাযি.) গিয়ে এ ঘটনা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর কাছে বর্ণনা করেন। তখন হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ বিয়ে প্রত্যাখ্যান করেদেন। এবং সাহাবীকে বলেন যে, যাও গিয়ে নিজের ইচ্ছামত বিয়ে করে নাও।

ব্যাখ্যাঃ এ উভয় হাদিস এ কথার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, হাদিসে উল্লিখিত মহিলা সাহাবীদ্বয়ের পিতৃবৃন্দ তাদেরকে তাদের অসম্মতিতে জোর জবরদস্তিমূলক ভাবে বিয়ে করিয়ে দিয়েছিল, অথচ তারা উভয়ই প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানী ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাদেরকে স্বীয় ইচ্ছাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা প্রদান করে ছিলেন। স্পষ্টতঃ বিয়ে করিয়ে দেয়ার পরও তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তোমাদের ইচ্ছাধিকার রয়েছে। তোমরা বিয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত। তুমি নিজ ইচ্ছামত অন্যত্র বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হতে পার। তোমাদের পিতা কর্তৃক সম্পাদিত বিয়ে বাতিল বলে গণ্য।

হাদিসের আলোকে এখানে মহিলাদের অভিভাবককে বলা হয়েছে যে, প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মেয়ের বিয়ের স্বাধীনতা তাদেরকে দেয়া হয়েছে। বাহ্যিকভাবে শুধু তাদের এ সম্মান দেয়া হয়েছে যে, অভিভাবক পৃষ্ঠপোষক হওয়ার কারণে বিয়েটা তিনি পড়িয়ে দিবেন। কিন্তু এ বিয়ে পড়ানোটাও মহিলাদের মর্জি ও অনুমতিক্রমে হওয়া জরুরী। এতে পুরো বংশের মান মর্যাদা রক্ষা পায়। সকলের দিকটা এতে বিবেচিত হয়। কিন্তু চাপ প্রয়োগ করে জোর জবরদস্তি করে বিয়ে দেয়ার অধিকার তাদের নেই।

১৩। হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি স্বীয় ভাতিজী হাফসা বিনতে আবদুর রহমানকে মুনজের ইবনে যুবায়ের এর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ তখন হযরত হাফসার পিতা আব্দুর রহমান উপস্থিত ছিলেন না। কোন এক সফরে ছিলেন। যখন তিনি সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন তিনি এ বিয়ে সম্পর্কে অবগত হয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন বটে, কিন্তু অগ্রহণযোগ্য মনে করেননি। বরং তা বহালই রাখলেন। এঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পিতার অনুপস্থিতিতে যদি অপর কোন নিকট আত্মীয় ইচ্ছে করে, চাই সে পুরুষ হোক কিংবা মহিলা হোক, তাহলে সে প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলার বিবাহ তার সম্মতিতে দিতে পারবে। অভিভাবকের অনুমতি বিয়ের বেলায় ফরয বা ওয়াজীব কিছু নয়।

যদি এমনটিই হতো, তাহলে হযরত আব্দুর রহমান (রাযি.) সফর থেকে প্রত্যাবর্তনের পর অসন্তুষ্টি প্রকাশের সাথে সাথে বলে দিতেন যে, বিয়ে আমার অনুমতি এবং মর্জি মুতাবিক নয় বিধায় আমি তার বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছি। কিন্তু তিনি এমনটি করেননি। তবে হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর হাদিসের দৃষ্টিতে অভিভাবকের অনুমতিক্রমে হওয়াটা মুস্তাহাব। এবং তা শরীয়তের দৃষ্টিতে সর্বোত্তম পদ্ধতি। যেহেতু তা সমাজ ও প্রচলনের মুতাবিক হয়ে থাকে। কাজেই এখানে যেহেতু সামাজিকতা রক্ষা করা হয়নি, এজন্যেই তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সুতরাং আজো যদি কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ও একান্ত প্রয়োজন ব্যতিত কোন প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলার সুন্নাত সম্মত ও মুস্তাহাব পদ্ধতি (অথাৎ- স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ও সম্মতি) ব্যতিত নিজ পছন্দের কোন ছেলেকে বিয়ে করে নেয়, তাহলে তাকে সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে ন্যাক্কারজনক এবং শরীয়তের দৃষ্টিতেও অত্যন্ত গর্হিত কাজ হিসাবে গণ্য করা হবে। এতদসত্ত্বেও বিয়েকে বাতিল বা অগ্রহণ যোগ্য বলা যাবে না।

১৪। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা (রাযি.)কে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, তখন তিনি প্রথা ও প্রচলন অনুযায়ী বললেন যে, বর্তমানে আমার কোন অভিভাবক এখানে উপস্থিত নেই। সুতরাং আমি এখন একা একা কী বলব? এতে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন, উপস্থিত অনুপস্থিত এমন কোন অভিভাবক তোমার নেই যে, তোমাকে আমার নিকট বিয়ে দেওয়াটা ভাল মনে করবে না। অতঃপর হযরত উম্মে সালমা (রাযি.) নিজের নাবালেগ অথচ অত্যন্ত চতুর ছেলেকে ডেকে পাঠালেন যে, যাও তুমি তোমার আম্মাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর নিকট বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কর। অতঃপর উক্ত ছেলে বিয়ের সার্বিক ব্যবস্থাপনা সেরে স্বীয় মাতাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর সাথে বিয়ে করিয়ে দিলেন। এভাবে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিতই উম্মুল মুমিনীন এর বিয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর সাথে সম্পন্ন হয়।

ব্যাখ্যাঃ একটু লক্ষ্য করুন যে, উক্ত হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বিয়ের প্রস্তাবের পর উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা (রাযি.) প্রথা ও সমাজিকতার দিকে লক্ষ্য করে বলে দিলেন যে, একা একটি মেয়েলোক কী উত্তর দিবে? আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর উত্তরে বললেন, তোমার অভিভাবকের মাঝে এমন কেউ নেই যে, এ বিয়ের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবে। সুতরাং তুমি আমার সাথে বিয়ের ব্যাপারে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিতে পার। তখন তিনি স্বীয় এমন ছেলে, যে প্রকৃতপক্ষে অভিভাবক নয় এবং তার মধ্যে অভিভাবকত্বের যোগ্যতাও নেই, তারপরেও তাকে প্রতিনিধি সাব্যস্ত করে বিয়ে পড়িয়ে দিতে বললেন। ফলশ্রুতিতে একটি অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক ছেলের প্রতিনিধিত্বে উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমার বিয়ে শরীয়ত সম্মতভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর সাথে সম্পন্ন হল।

এ থেকে বুঝা গেল যে, অভিভাবক উপস্থিত থাকা বা তার অনুমতি বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার জন্যে ফরয ওয়াজিব বা শর্ত এমন কোন কিছুই নয়। বরং এগুলো ব্যতিতই প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলার বিয়ে শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পন্ন হতে পারে। তবে হ্যাঁ, অভিভাবকের অনুমতি ও উপস্থিতিতে বিয়ে সম্পন্ন করা সবচে উত্তম। সমাজ ও প্রচলনের মুতাবিক। কিন্তু যদি কখনো কোন যুক্তি সঙ্গত কারণ বা প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে এগুলো বাদও দেয়া যেতে পারে। কারণ বিয়ের বিশুদ্ধতা এর উপর নির্ভরশীল নয়। প্রকাশ থাকে যে, এখানে কেউ শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশ্ন করতে পারে যে, উক্ত হাদিসে বিয়ে কর্তা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.), কাজেই এটা সমস্ত উম্মতের জন্যে প্রমাণ কিভাবে হতে পারে। এভাবে বিয়ে করা তো রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বৈশিষ্ট্যও হতে পারে। এর উত্তর স্পষ্ট, কারণ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বৈশিষ্ট্য হাদিস কুরআনে উল্লেখ আছে, হয়তো সরাসরি, নতুবা আকার ইঙ্গিতে এ উল্লেখ থাকার ভিত্তিতে ধরা হয় যে, কোনটা তাঁর বৈশিষ্ট আর কোনটা তাঁর বৈশিষ্ট নয়।

উম্মতের জন্যে এক সাথে বড় জোর চারটা পর্যন্ত বিয়ে করা বৈধ আছে, এর অধিক বিয়ে করা জায়েয নেই। কুরআন হাদিসে এ ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে। ঠিক তদ্রƒপ “সাওমে বেছাল” অর্থাৎ বিরামহীন রোযা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বৈশিষ্ট্য। তা উম্মতের জন্যে নিষিদ্ধ। নফল নামায দাঁড়িয়ে বসে উভয় অবস্থায় সমান সাওয়াব পাওয়া এটা নবী (আ.)এর বৈশিষ্ট্য। আর উম্মতের বেলায় তা দাঁড়িয়ে পড়লে পূর্ণ সাওয়াব আর বসে পড়লে অর্ধেক সাওয়াব হিসাবে বিদিত। এ ধরণের আরো অনেক বিষয় আছে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলার বিয়ে অভিভাবক ব্যতিত সম্পাদন করা যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর বৈশিষ্ট্য এর কোন কারণ ও প্রমাণ হাদিসে উল্লেখ নেই। পক্ষান্তরে দশ দশটির মত বর্ণনা এমন আছে, যা এ ব্যাপারে বৈশিষ্ট না হওয়ার প্রমাণ বহন করে।

১৫। বায়হাকীতে এসেছে, যার মমার্থ হলো এই যে, জনৈকা মহিলা তার মেয়ের বিয়ে তার পূর্ণ সম্মতিতে করিয়ে দিয়েছিল, অথচ অভিভাবকের অনুমোদন নেয়নি। হযরত আলী (রাযি.) এই বিয়েকে বহাল রেখে ছিলেন। দেখুন, এখানে মা তার মেয়ের বিয়ে মেয়ের সম্মতিতে করিয়ে দিয়েছে। হযরত আলী (রাযি.) এ বিয়েকে বৈধ বলে সাব্যস্ত করেছেন। এমনটি বলেননি যে, অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত বিয়ে হয়ে যায়।

১৬। হযরত আলী (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তাঁর কাছে যদি এমন কোন ব্যক্তি আসত, যে কোন প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলাকে তার সম্মতিতে এবং অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত বিয়ে করেছে এবং তারা সহবাসও করে ফেলেছে, তাহলে তিনি এ লোকের বিয়েকে বহাল রাখতেন। উক্ত বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, ইসলামের চতুর্থ খলিফা যিনি একজন সুশাসক, ফিক্বাহবিদ এবং একজন সুবিচারকও বটে। তার কর্মপন্থা ছিল কোন পুরুষ এবং প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলা যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে শরীয়ত সম্মত ভাবে বিয়ে করে নেয় এবং এর সমর্থনের জন্য তারা তার দ্বারস্ত হয়, তাহলে তিনি তার সমর্থন করতেন। এ ধরণের বিয়ে যদি অগ্রহণযোগ্যই হত এবং তা কুরআন সুন্নাত পরিপন্থী হত, তাহলে অন্তত তিনি এটাকে বহাল রাখতেন না। কারণ তিনি একজন বিশিষ্ট সাহাবীই নন বরং ফিকাহবিদ, সুবিচারক, খলিফা এবং আদালতী বিষয়াদী সম্পর্কে সম্যক অবগতও ছিলেন। এর পরেও তিনি তা কিভাবে বহাল রাখতেন। বুঝা গেল যে, কুরআন সুন্নাহের আলোকে মাসআলা হল এটাই যে, প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলার বিয়ে পূর্ণ সম্মতিতে যদি সমকক্ষ কোন পরিবারে হয়, তাহলে তা বৈধ হবে।

১৭। বুখারী শরীফে বিশিষ্ট সাহাবী আবদুুর রহমান ইবনে আওফ (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি একবার উম্মে হাকীম বিনতে কাবেয (রাযি.)কে বললেন, আপনি কি আপনার বিয়ের ইচ্ছাধিকার আমার উপর অর্পণ করবেন? উম্মে হাকীম উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আমি আমার বিয়ের ইচ্ছাধিকার আপনার উপর অর্পণ করলাম। তখন আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাযি.) বললেন, আমি তোমাকে বিয়ে করলাম। (খ:২ পৃ:৭৭০)। লক্ষ্য করুন, এখানে প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলার সম্মতিতে ঘটে যাওয়া হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফের বিয়ের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এখানে অভিভাবক থেকে অনুমতি নেওয়া বা অভিভাবকের অনুমতির উপর নির্ভরশীল হওয়ার কোন কথা উল্লেখ নেই। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাযি.) ছিলেন প্রথম সারির সাহাবীগণের মাঝে অন্যতম। দু’ দু’ বারের মত তিনি হিজরত করেছেন মদিনা এবং আবিসিনিয়ায়। তদুপরি তিনি বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশ জনেরও অন্যতম। এমন একজন সাহাবীর আমল নিঃসন্দেহে কুরআন সুন্নাহ্র মোতাবেকই ছিল। কুরআন সুন্নাহ্র পরিপন্থী অবশ্যই ছিল না। যদি তাই না হত, তাহলে ঐ সময় অসংখ্য ফিক্বাহবিদ সাহাবী বিদ্যমান ছিলেন, তারা অবশ্যই এর বিরুদ্ধে ফাত্ওয়া জারি করতেন। কিন্তু সমগ্র হাদিস ভান্ডারের কোথাও এমনটি পাওয়া যায়নি।

১৮। মিশরের বিচারপতি উকবা ইবনে আমের (রাযি.) বর্ণনা করেন। একবার রাসূলুল্লাহ্ (সা.) জনৈক ব্যক্তিকে বললেন, তুমি কি এতে সম্মত আছ যে, অমুকের সাথে তোমার বিয়ে করিয়ে দেব। উত্তর দিলেন, হ্যাঁ! ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি এতে সম্মত আছি। অতঃপর তিনি (সা.) ঐ মহিলার কাছে গিয়ে বললেন, তুমি কি এতে সম্মত আছ যে, তোমাকে অমুকের সাথে বিয়ে করিয়ে দেব। তিনিও উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) উভয়কে ডেকে বিয়ে করিয়ে দিলেন।

ইমামুল হাদীস ইমাম আবু দাউদ (রাহ্.) এ হাদীসকে বিশুদ্ধ সনদের সাথে বর্ণনা করেছেন। ইলাউস সুনান প্রণেতা বলেন, বিশুদ্ধতার দিক থেকে হাদীসটি বুখারী মুসলিম শর্তে পড়ে।

আরও পড়তে পারেন-

প্রিয় পাঠক সমাজ! আপনারা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) দুই বালেগ ছেলে মেয়ের বিয়ে তাদের অভিভাবকদের জিজ্ঞাসা করা ব্যতিত করিয়ে দিলেন। এসব হাদীস ও বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলার বিয়ে অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিতই দুরস্ত হয়ে যাবে। কুরআন হাদীসের দৃষ্টিকোন থেকে যা অনস্বীকার্য। এটাই হল হানাফীদের অভিমত। এ মাযহাবের উপর এতক্ষণ কুরআন হাদীসের আলোকে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। এবার ফিক্বহী বর্ণনা বিবৃতির আলোকেও এ মাযহাবের উপর প্রমাণ পেশ করা যাচ্ছে।

১৯। আল্লামা কাছানী (রাহ্.) স্বীয় সুবিখ্যাত ফিক্বাহ্গ্রন্থ বাদায়েতে লিখেন, যার সারমর্ম হল এই যে- প্রাপ্ত বয়স্কা জ্ঞানী মহিলার বিয়ের অধিকার তার হাতেই হওয়া যুক্তিযুক্ত, অভিভাবকের হাতে নয়। তার কারণ বিয়ের প্রয়োজন তো তার, আর তাকেই স্বামীর সাথে জীবন যাপন করতে হবে। যদিও কিছু কিছু বিষয় এমন আছে, যা অভিভাবক বুঝে থাকেন কিন্তু অধিকাংশ ভাল মন্দের দিক মহিলা নিজেই বুঝে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ কোথায় এবং কার থেকে প্রেম-ভালবাসা বেশী মিলবে, কোথায় আত্মার প্রশান্তি অধিক লাভ হবে, কোথায় ভাল অন্ন-বস্ত্র আর বাসস্থানের ব্যবস্থা হবে। কোথায় দ্বীন-দুনিয়ার সফলতা বেশী পাওয়া যাবে। ভাল বংশ পরস্পর কোথায় লাভ হবে, কোথায় সন্তান সন্ততির জন্ম ও প্রতিপালন সর্বোত্তম পন্থায় আঞ্জাম দেয়া সম্ভব হবে। এ সব বিষয়কে মহিলারা বুঝে এবং ফিকির করে। আবার মহিলাদের মেজাযেরও ভিন্নতা আছে। এ ভিন্নতার কারণে মহিলাদের মেজাযের অবস্থা তারাই বেশী বুঝবে। পুরুষরা তা অনুভব করতে পরবে না। অনেক সময় একই বংশের এমন কি একই পিতার একাধিক মেয়েদের মেজাযের মাঝে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তারা একেক জন স্বামী বরণের ব্যাপারটি একেক ভাবে চিন্তা করে থাকে। কারো মেজাযে দ্বীন ধর্মের বিষয়টি প্রধান বিবেচ্য থাকে, এমনি ধৈর্য অল্পতুষ্টি ইত্যাদি ইতিবাচক গুণাবলী অধিক পরিমানে বিদ্যমান থাকে। অথচ অন্য মেয়েদের মেজাযে দ্বীন ধর্মের সাথে সাথে দুনিয়ার বিষয়টিও বিবেচ্য থাকে। বিধায় তার মাঝে ধৈর্য, অল্প তুষ্টির গুণাবলী সেই পরিমানের হয় না, যে পরিমাণের প্রথমোক্ত মহিলাদের মাঝে হয়ে থাকে।

পক্ষান্তরে তৃতীয় আরেক প্রকার মহিলা রয়েছে, যাদের লক্ষ্য থাকে অন্য কিছুর প্রতি। মোটকথা, পবিত্রতা আর ইজ্জত সম্ভ্রমের সাথে সাথে তারা স্বীয় স্বামী সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় সম্পর্কেই চিন্তা ফিকির করে থাকে। সুতরাং এটার কোন কারণই হতে পারে না যে, মহিলারা বিয়ের পর সারা জীবন একজন পুরুষের তত্বাবধানে জীবন কাটাবে, আর পুরুষ নির্বাচনে তার দিকে মোটেও ভ্র€ক্ষেপ করা হবে না। এসব কারণে ফিকহী বর্ণনা, বিবৃতি ছাড়াও জ্ঞান ও যুক্তি বুদ্ধির দাবীও তাই যে, প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলার বিয়ের ব্যাপারে তার ইচ্ছা এবং রায়ের সর্বোŽচ গ্রহণযোগ্যতা থাকুক আর অভিভাবককে পৃষ্ঠপোষক হওয়ার কারণে যদিও কিছুটা ইচ্ছাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তবে তা নিতান্তই গৌণ পর্যায়ের হোক, মহিলার সিদ্ধান্তই এ ব্যাপারে মুখ্য হোক। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে বাদায়ে খ:২ পৃ:২৪৯ দেখতে পারেন)।

২০। কুরআনের আয়াতে এবং হাদীসের বাণী ও অন্যান্য আরো কিছু দলিল প্রমাণ বর্ণনাও এ যুক্তির সমর্থন জোগায়। তাছাড়াও কুরআন হাদীস সব ধরনের কার্যক্রমে চাই তা ইহলৌকিক হোক বা পারলৌকিক, অর্থনৈতিক বিষয় হোক কিংবা অন্য যে কোন বিষয়, সব ধরণের বিষয়ের বেলায় মহিলাদেরকে কুরআন-হাদিস স্বাধীন ইচ্ছাধিকারী সাব্যস্ত করেছে এবং তাদের ক্রিয়া কলাপকে দুরস্ত এবং যথার্থ বলে মূল্যায়ন করেছে। তাহলে আবার বিয়ের বেলায় কেন? তাদেরকে স্বাধীন ইচ্ছাধিকারী মানা হবে না? যেমন- মহিলারা তাদের ভূসম্পত্তিতে ও অন্যান্য মাল ও আসবাবে স্বাধীন ইচ্ছাধিকারী। ইচ্ছা করলে সে তা বিক্রি করে দিতে পারে অথবা সদকাও করে দিতে পারে কিংবা যে কারো জন্যে তা অসিয়তও করে যেতে পারে। এতে কারো আপত্তি উত্থাপন কিংবা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার নেই। তাদের হাতে যদি শরীয়ত সম্মত কোন দাস বা দাসী থাকে, তাহলে সে তাকে বিক্রি করতে পারবে, আর চাইলে আযাদও করে দিতে পারে। অন্য কেউ এখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে না।

এ জন্যেই ইমামে আযম আবু হানিফা (রাহ্.)সহ তার অসংখ্য শিষ্যবৃন্দ বিশেষ করে বড় বড় শাগরেদ, যেমন- ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ প্রমুখ ইমাম মহোদয়গণ ফাত্ওয়া দিয়েছেন যে, প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলারা যেহেতু অন্যান্য সব কার্যক্রম আঞ্জাম দেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে।

সুতরাং তারা স্বীয় সত্তার মাঝে এবং নিজ বিয়ের ব্যাপারেও স্বাধীন ইচ্ছাধিকার সংরক্ষণ করবে। কাজেই কোন মহিলা যদি সমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করতে চায়, তা পারবে। চাই অভিভাবক এর উপর সম্মত থাক বা না থাক, অভিভাবকের অনুমতি সংগ্রহ করা হোক কিংবা না করা হোক, এ ধরণের বিয়ে সম্পন্ন করার পর তা সংঘটিত হয়ে যাবে। তখন মহিলা বা মহিলার পৃষ্ঠপোষক কিংবা অভিভাবকের কারোই আপত্তি উত্থাপনের অধিকার থাকবে না।

তবে কোন প্রাপ্তবয়স্কা জ্ঞানী মহিলা যদি কোন অসমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করে ফেলে, তাহলে সেখানে কী করতে হবে এব্যাপারে কথা হল এই যে, বিয়ের পরে কোন কারণে অভিভাবক যদি অনুমতি দিয়ে দেয়, তাহলে জাহেরী বর্ণনা মুতাবিক এমন বিয়েও দুরস্ত আছে। বিয়ে নবায়নের কোন প্রয়োজন নেই।

আর যদি অভিভাবক এর উপর সন্তুষ্ট না থাকে, তাহলে আদালতে পাত্র পরিবারের অসমকক্ষতা প্রমাণ করে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে। মোট কথা অসমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করলে এতে অভিভাবকের আপত্তি উত্থাপনের অধিকার থাকবে।

[চলবে]

– আল্লামা মুফতি আব্দুচ্ছালাম চাটগামী, মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ এবং পরিচালনা পরিষদের প্রধান, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

প্রথম কিস্তি পড়ুন- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান

তৃতীয় কিস্তি পড়ুন- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান