Home ইতিহাস ও জীবনী স্মৃতিকথায় বাবা!

স্মৃতিকথায় বাবা!

।। মুশতারী তাসনীম মুননী ।।

“একসময় বড়ো মাপের লেখিকা হবি, এই নে, এই ডায়েরিতে রোজনামচা লিখবি। একসময় তা আত্মজীবনী হবে”।

কে জানতো সেই ডায়েরির একটা পেইজে লিখতে হবে জীবনের সবচেয়ে কাছের প্রিয়জন হারানোর ব্যথা। বড়ো লেখিকা হতে পারিনি কিন্তু কিন্তু বড়ো আদুরে মেয়ে ছিলাম বাবার।

আমার স্মৃতিতে যতটুকু মনে পড়ে, বাবাকে আমরা আজীবন অতিথি হিসেবেই পেয়েছি। ব্যস্ত জীবনে তিনি সময় দিতে পারেননি অতটা।

এখন বলতে দ্বিধা নেই, আমরা বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। তার প্রথম পক্ষ নারায়ণগঞ্জ। ওখানে তার ভরপুর সংসার। রয়েছে বড়ো পাঁচ ভাই, তিন বোন। রয়েছেন একজন মা। শৈশবে কখনোই তাদের সাথে দেখা হয়নি। তাদের দৃষ্টিতে আমরা অপরাধী। বাবা কখনও চাননি আমরা এগিয়ে তাদেরকে আমাদের সম্পর্কের সেতু তৈরি করি। তার সন্তান। তিনিই ভালো জানেন। আমরাও মঙ্গল ভেবে আর এগিয়ে যাইনি।

আমাদের কাছে বাবাই সব। দেশজুড়ে পরিচয় নিয়ে গর্বিত হতাম আমরা। তাঁর জ্ঞান, তাঁর আদর্শ তাঁর শিক্ষা আমাদের সম্পদ। আমাদের বটবৃক্ষ ছিলো তিনি।

ছেলেবেলায় বাবাকে ভীষণ ভয় পেতাম। দূর হতে দাঁড়িয়ে সালাম দিতাম। আস্তে করে হাসতাম। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতাম। বাবা ভাষার শুদ্ধতা পছন্দ করতেন। বলতেন, একজন মানুষের ব্যবহারের প্রথম সৌন্দর্য তার ভাষা।

ছোট হতেই বাবাকে দেখেছি পরিপাটি পোশাক পরতে। পরিচ্ছন্ন জীবন পছন্দ ছিলো। আমি আস্তে আস্তে বড়ো হতেই গোছানো হয়েছি। সবাই বলতেন বাবার মতো। ভালো লাগতো শুনতে। এরপর তা বাবার দৃষ্টিতে এলো। তিনিও খুশি হতেন। বলতেন গোছানো সংসার বরকতপুর্ণ হয়।

আমার কাজগু‌লো‌তে বাবা খুশি হয়ে বলতেন, তুই আমার মায়ের মতো। আমাকে বরাবর মা বলেই ডাকতো। কি মধুর সে ডাক।

তখন সেভেন ক্লাসে পড়ি।

প্রথম হাতে এলো আদর্শ নারী পত্রিকা। বাবার ইচ্ছে হলো আমি লিখি। কিন্তু আমি অতো গুছিয়ে গুছিয়ে কিছু লিখতে বুঝতাম না। পরবর্তীতে কাবার পথে আমার ছোট্ট ছোট্ট লেখা প্রকাশ হতে লাগলো। বাবা কি যে খুশি। তিনিই শিখিয়েছেন কখনও একলাফে আসমান ছোঁয়া যায় না। ধৈর্যের আধার ছিলেন তিনি।

ইতিহাস, ঐতিহ্য তার মুখস্ত ছিলো মাশাআল্লাহ। খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে এতো এতো গল্প বলতেন, শৈশবে আমি খালিদ বিন ওয়ালিদ, ওমর এর মতো বীর হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম আবু বকরের সততার স্বপ্ন। কিংবা ওসমান, আলীর গুণাবলীতে মুগ্ধ হতাম তখন।

কখনও ওসমানীয় শাসন। কখনও তুর্কিদের যুদ্ধ জয়ের গল্প। কখনও স্পেনীয় শাসন, সেখানকার মুসলিম শাসকদের অধপতনের গল্প। কখনও ভারতজয়ের গল্প। কখনও রোমীয় শাসনের গল্প। আফগান, ইরাকের অলিগলি যেন বাবার দৃষ্টি দিয়েই চেনা। কাশ্মীর যেন তাঁর গল্পকথায় স্বপ্নপুরী হয়েছিল আমার।

আমাদের এসব গল্প শুনতে শুনতে রাত গভীর হয়ে যেত। আম্মুর শাসনে শেষে আমরা সমাপ্তির পথে আসতাম।

তখন নাইনের ক্লাসে।

বাবা প্রথম ঐতিহাসিক সিরিজ ধরিয়ে দিয়েছিল। একে একে বই পোকা হয়ে যাই আমি। ক্লাস টেনে আমার বিশাল এক বইয়ের রাজত্ব তৈরি হয়। কি ভালোলাগা এই জগতে। বাবার হাত ধরেই এখানে আসা।

বাবার হাতের লেখা সুন্দর হলে খুব পছন্দ হতো। আর্টের প্রতি তার সৌখিনতা ছিলো।

তিলাওয়াতের সুর শুনতাম সবসময়। শুয়ে শুয়ে, বন্ধ চোখে গুনগনিয়ে তিলাওয়াত তার রুটিন ছিলো। ভীষণ রকমের বই পড়ুয়া বাবা আমার। পেপার পড়লে সম্ভবত এক অক্ষরও বাদ যেতো না। এক ঘেয়েমি আমরা দেখিনি।

আমরা বাবাকে পেয়েছি পথপ্রদর্শক হিসেবে। কখনও ধর্মীয় ব্যপারে গোঁড়ামি দেখিনি। স্বচ্ছ, সুন্দর রুচিবোধ ছিলো আলহামদুলিল্লাহ।

একটু বড়ো হতেই বাবার সাথে জমে ওঠে দ্বীনি মুজাকারা। ক্লাস সেভেন এর সময় বাড্ডা কুড়িল এ আবিদাতুন্নিসায় মুয়াল্লিমা ট্রেনিং দেই। বাবার ইচ্ছেতেই। এরপর যখনই বাড়িতে আসতেন পড়াগুলো নিতেন। ভয় পেতাম, কি গুরুগম্ভীর তখন। সব মিলিয়ে একজন উস্তাদ তিনি আরবির জগতে।

আমরা দ্বিতীয় পক্ষে চার ভাইবোন। আমিই বড়ো ছিলাম। এরপর জমজ দুটি বোন। এরপর ভাই। একমাত্র ভাই। বাবার খুব আদরের। বাবা ওর নাম দেয় রেদোয়ান।  বাবার ইচ্ছেতেই ওর হেফজ শুরু হয়। বাড়িতে রেদোয়ানকে পেলেই তিলাওয়াত করতে বলতেন। আর বলতেন, বড়ো বড়ো ক্বারীদের তিলাওয়াত শুনতে। তাহলে তিলাওয়াত শুদ্ধ ও সুন্দর হবে।

আরও পড়তে পারেন-

আমার মা দীর্ঘ বছর ধরে মক্তব পড়িয়ে আসছেন বিনামূল্যে। বাবার পারমিশনে বাসায় দ্বীনি তালিমে বসতেন আম্মু। বাবা খুশি হতেন। বলতেন, তুমিতো আখিরাত গুছিয়ে নিচ্ছো। আখিরাতে আমাকে চিনবে তো?

তখন আমি আলিম ক্লাসে।

বাবার পছন্দ করা ছেলের সাথেই বিয়ে হয় আমার। বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে। সেদিন সকাল বেলা ফোনে তিনি আমার থেকে অনুমতি চেয়ে নেন। তখন আমি বলেছিলাম, আমার বিয়ে যেন পড়াশোনার বাধা না হয়। আমি শেষ অব্দি পড়তে চাই। রাজি ছিলেন তিনি। তিনি বলতেন, শিক্ষা আমার অবর্তমানে তোদের অভিবাবকের দায়িত্ব নিবে। অন্য ভাইবোনদের পড়াশোনার বিষয়াদি খোঁজ নিতেন। আমার মাস্টার্সের রেজাল্ট শুনে আমার কপালে স্নেহ চুমু দিয়েছিলেন।

বাবাকে নিয়ে ভালোবাসার স্মৃতি ছাড়াও রয়েছে বিরহ ব্যথার স্মৃতি।

প্রথম পক্ষ ছিলো তার কাছে সবার ঊর্ধ্বে। আমাদের সাথে আজ অব্দি কোনও ঈদ উদযাপন করতে পারেননি। ঈদের নামায শেষে তাঁর গন্তব্য ছিলো নারায়ণগঞ্জ। সপ্তাহ পেরিয়ে পরে বরিশাল। আমরা এমন রীতিতেই অভ্যস্ত ছিলাম। সারা বছর মাস শেষে অতিথি হিসেবে দু’তিন দিন কাটিয়ে যেতেন। আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের অভিভাবকের ভূমিকায় বরাবরই আম্মু ছিলেন।

আমাদের পিতার স্থান ধরে রাখতে তাঁরও কম খেসারত যায়নি। নিজের উপার্জিত সম্পদ, নিজের সম্মান সবটুকুই বিসর্জন দিয়েছিলেন আমাদের জন্য। বহু সমস্যা উপেক্ষা করে আমাদের জন্য তিনি ভালোবাসা রেখে গিয়েছেন।

প্রথম বার হজ্ব শেষে দেশে আসার পর বলেছিলেন, “আমি কাবা ছুঁয়ে আল্লাহর কাছে বলে এসেছি, তোদের জন্য তিনিই অভিবাবক হয়ে থাকবেন। আমি তাঁর হাতেই তোদের সোপর্দ করে এসেছি। অনেক ভালো থাকবি তোরা। তোদের সবর তোদের সব কিছুই পাইয়ে দিবে, ইনশাআল্লাহ”।

আমরা এ জীবনে কোনও দিন বাবার কথার দ্বিমত হইনি। অবাধ্যতা আমরা করিনি কখনও। ব্যথাতুর কোনও বাক্য বলিনি আমরা। আমৃত্যু তিনি খুশি ছিলেন আমার মায়ের প্রতি, আমাদের প্রতি। আলহামদুলিল্লাহ।

বাবা ভোজন রসিক ছিলেন। ছেলেবেলায় নানুমনি বাবার জন্য হরেক রকম পিঠা বানাতেন। আর বাবাও তৃপ্তি ভরে তা খেতেন। এরপর আমরা পিঠাপুলি করলে পাশে বসে দেখতেন, আর আড্ডা জমে উঠত। ওই পিঠা এমনিতেই স্বাদ হতো।

মায়ের হাতের রান্না খুব পছন্দ তার। রকমারি রান্না তার খাবারকে তৃপ্তির প্লেটে পৌঁছে দিতো।

বাবা চলে যাবার দুদিন আগে প্রায় আধাঘন্টা ধরে কথা বলছিলেন। বরিশাল আসার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন।

আমি তখন বরিশালেই ছিলাম।

মা কে বললাম, বাবাকে নিষেধ করুন আসতে। এই লকডাউনে পুলিশ অজুহাত দেখিয়ে হয়রানি করতে পারে। কারণ, বহুদিন ধরেই বিভিন্ন ইসলামী আলোচকদের ওপর যেই জুলুম চলছে, সেই ভয়েই না করেছিলাম।

কে জানতো, এই নিষেধাজ্ঞা আজীবন থাকবে। আর কখনও ফিরবেন না বরিশাল।

বাবা আমাকে বেশী ভালোবাসতন। এজন্যই তার মসজিদের কাছাকাছি আমার শশুরবাড়ি ছিলো। আমি প্রতি সপ্তাহে তার খুতবা শোনার আগ্রহে থাকতাম। জুমাবার এলেই প্রাণে আলাদা শক্তি কাজ করতো। মনে হতো বাবা আমার নাগালেই আছেন। মসজিদ ডিঙ্গিয়ে যখন আমার শশুরবাড়ী ফিরি, তখন ওই মসজিদ আমাকে তাজা শোক মনে করিয়ে দেয়। বাবাবিহীন ওই মিম্বর আমার কাছে অসহনীয় বেদনার। বাবা ছাড়া ওই সুর আমার বড়ো অচেনা। বাবা ছাড়া ওই মসজিদ যেন বিরহের মঞ্জিল।

আমি জানি না, তাঁর প্রথম পক্ষ কখনও আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্কে নিবে কিনা। শুধু এতটুকুই জানি, একই রক্ত ধমনীতে। একই পরিচয়ে আমরা বাবার সন্তান। একই অধিকার, একই হক তার সবকিছুতে। তারাও আলেম। দোয়া করি, তাদের হৃদয়ে আল্লাহ খোদাভীতি এবং দ্বীনী সম্মান বজায় রাখুক।

বাবা, আপনি নেই। আপনার কবর সেদিন দুর হতে দেখেছি। কখনও আপনাকে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য আর হবে না। আপনার আদর্শ, আপনাকে দেয়া ওয়াদা আমরা রেখেছি। আমৃত্যু আমরা আপনার সম্মান ধরে রাখবো, ইনশাআল্লাহ।

আপনার প্রভাব প্রতিপত্তি আমাদের জন্য কখনোই লোভনীয় ছিলো না। কেননা, আপনার দোয়া আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিলো। জানি এই দোয়ার বরকতে আমরা অনেক ভালো থাকবো আল্লাহ চাইলে।

আপনার আমার সৃ‌ষ্টিকর্তা আপনাকে ক্ষমা করুক। আপনার ভুলত্রুটি আমরা ক্ষমা করেছি। কোনও দাবী নেই, নেই আক্ষেপ। শুধু আরও কিছু বছর আপনার দোয়ার অনুরাগী ছিলাম আমরা।

হে আরশের মালিক, বাবার জন্য জান্নাত বরাদ্দ করুন, সমস্ত ভুল মার্জনা করে আপন করে নিন। আখিরাতে একসাথে যেন জান্নাতের বাগিচায় আবারো জমে মিলনমেলা। আমাদের সকল অপুর্ণতা যেন জান্নাতের জন্য হয়। সবর রাখার তাওফীক দিন আমাদের।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।