Home ইতিহাস ও জীবনী মাওলানা মাহমুদ হাসান: রেশমী রুমাল আন্দোলনের নেতা

মাওলানা মাহমুদ হাসান: রেশমী রুমাল আন্দোলনের নেতা

।। কে. এস. সিদ্দিকী ।।

ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত খেলাফত ও রেশমী রুমাল আন্দোলনের প্রাণপুরুষ এবং দেওবন্দের সুবিখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান (রহ.) এর ওফাত বার্ষিকী ৩ নভেম্বর। ১৯২০ সালের এইদিন তিনি ইনতেকাল করেন। তিনি ‘শায়খুল হিন্দ’ নামে সুবিখ্যাত। তিনি ডা. মোখতার আহমদ আনসারীর গৃহে ইনতেকাল করেন। তার জানাজার পর দিল্লী হতে দেওবন্দ আনা হয় এবং যেখানে তাকে দাফন করা হয়। মাওলানা মোহাম্মদ আলী তার ইনতেকালের খবর শুনে বলেন, তার ওফাত আমার কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, কোনো কোনো লোক তাকে আসীরে মাল্টা বা মাল্টার কয়েদি বলে থাকে। আমি বলবো তিনি ছিলেন, আমিরে মাল্টা। (মাল্টার শাসক)। তোমরা বলে থাকো শায়খুল হিন্দ (ভারত বর্ষের শায়খ) আমরা বলি, শায়খুল আলম (বিশ্বের শায়খ)। ভারতের এ দুই সেরা মণীষীর উল্লেখিত মন্তব্য ছাড়াও শায়খুল হিন্দের ইনতেকালে আরো অনেকে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেন।

দারুল উলুম দেওবন্দ কায়েম হওয়ার ১৫ বছর পূর্বে ১৮৫১ সালে মাওলানা মাহমুদ হাসান জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা জুলফিকার আলী ছিলেন বিখ্যাত আলেম। বেরেলীতে এ ঘরানার যথেষ্ট সুনাম ছিল। খোশহাল ও মুখ স্বাচ্ছন্দ্যের এ ঘরানা মানসম্মানে ও সুপরিচিত ছিল। মাওলানা মাহমুদ হাসানের পিতা সে যুগের সেরা আলেম মাওলানা মামলুক আলির নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

এ সম্পর্কে অপর একটি বর্ণনা অনুযায়ী, মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) ও স্যার সৈয়দ আহমদ খান, এ দুজনই ছিলেন মাওলানা মামলুক আলীর ছাত্র। একসঙ্গেই তারা তার কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে কর্মজীবনে এ দুজন দুই পদ্ধতির অনুসারী হয়ে বিশ্বে খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান আধুনিক শিক্ষা লাভ করে ইংরেজ সরকারকে সমর্থন করে স্যার উপাধি লাভ করেন এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইংরেজি শিক্ষা হতে বিরত থাকা মুসলমানদের সেদিকে আকৃষ্ট করতে গিয়ে নিন্দা সমালোচনারও অধিকারী হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, ইংরেজদের প্রতি সমর্থন করে তাদের ভাষা আয়ত্ব করেই তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। তার আলীগড় আন্দোলন ছিল এর প্রমাণ।

পক্ষান্তরে মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) যে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা কায়েম করে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষায় অনন্ত ধারার সূচনা করেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে দেওবন্দ উপমহাদেশের ‘আল-আজহার’ নামে খ্যাত। আর এ ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রের মাধ্যমে হজরত মাওলানা কাসেম নানুতবী ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ জেহাদের ডাক দেন এবং এ শিক্ষা কেন্দ্রের উলামা ছাত্রবৃন্দ স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণ করে যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন তা ইতিহাসের এক অতি উজ্জ্বল অধ্যায়। ইংরেজ বিরোধী দেওবন্দ আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে কত উলামা-মাশায়েখ শাহাদাত বরণ করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। খোদ মাওলানা মামলুক আলীও এক সময় দেওবন্দ আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন।

মাওলানা জুলফিকার আলী মাওলানা কাসেম নানুতবী এবং স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ওস্তাদ মাওলানা মামলুক আলী সম্পর্কে উলামায়ে হিন্দ কাশানদার মাযী নামক বিখ্যাত গ্রন্থে বলা হয়েছে, বালাকোট ঘটনার পর যখন এখানে পর্যবেক্ষণ বেড়ে যায় এবং কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে তখন তিনি মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুবের সঙ্গে হিজরী ১২৫৮/১৮৪২ সালে (অর্থাৎ বালাকোট ঘটনার এগারো বছর পর) মক্কা মোআজ্জমায় চলে যান, যাতে বহির্শক্তিগুলোর মাধ্যমে ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাহায্য করা যায় এবং এখানে কাজ করার জন্য তার ছাত্র মাওলানা মামলুক আলী সাহেবের নেতৃত্বে একটি বোর্ড গঠন করে দেন।

মাওলানা মামলুক আলী সাহেব সরকারি চাকুরে হিসেবে দিল্লী অ্যারবিক কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাকে সরকারের বিশ্বস্ত মনে করা হতো। তার নেতৃত্বে যে সংগঠন হচ্ছিল সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ-সংশয় ছিল না। কিন্তু ১৮৫৭ এর মোজাহেদীনের অধিকাংশ মাওলানা মামলুক আলীর ছাত্র ছিলেন। (২৫০-২৫১ ২য় খন্ড) গঠিত বোর্ডে সভাপতি হিসেবে মাওলানা মামলুক আলী বিশেষ দুইজন সদস্য মাওলানা শাহ আবদুল গণি ও ভুপালের নবাব নবাব সিদ্দিক হাসানের পিতা মাওলানা কুতুবুদ্দীন দেহলভী সমেত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মাওলানা মাহমুদ হাসানের পিতার ওস্তাদ মাওলানা মামলুক আলীর চিন্তাধারা পরিবারকে ইংরেজ বিরোধী করে তুলেছিল। এটি ছিল বাস্তব। মাওলানা মাহমুদ হাসানের পরবর্তী জীবনে তার প্রতিফলন রয়েছে।

মাওলানা মাহমুদ হাসানের শিক্ষা জীবনে ফিরে আসা যাক। তার শিক্ষা জীবনের প্রথমদিকের কথা, তার মাতা তাকে খুবই ভালোবাসতেন। এ সম্পর্কে খোদ তিনি বলেন, আমার প্রতি আমার মাতার এতই ভালোবাসা ছিল যে, তার সাথে কোনো তুলনাই হয় না। আমি দরসে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, ঘরে খাবার তৈরি হতো, সকলের খাবার শেষ হতো, কিন্তু আমার মাতা কিছু আটা আলাদা করে রেখে দিতেন। গরমকালে আমি যখন লেখাপড়া শেষ করে দুপুর বারোটা বাজে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতাম তখন তিনি সেই আটা দিয়ে টাটকা রুটি পাকিয়ে আমাকে খাওয়াতেন।

মাওলানা মাহমুদ হাসান মিয়াজী মঙ্গলোরীর নিকট কোরআনের অধিকাংশ পাঠ গ্রহণ করেন। মওলবী আবদুল লতিফের নিকট ফার্সির প্রাথমিক কিতাবগুলো পড়েন। তার বয়স যখন পনোরো বছর তখন দেওবন্দ আরবি মাদরাসা চালু হয়। তিনিও সেখানে ভর্তি হয়ে যান। তিনি প্রথমদিকের ছাত্রদের মধ্যে গণ্য হতে থাকেন। হিজরী ১২৮৯ সালে তিনি সিহাহ সিত্তার সকল হাদীসগ্রন্থ এবং ফনুনাত সমাপ্ত করেন। হিজরী ১২৯০ সালে মাদরাসার বার্ষিক সনদ প্রদান অনুষ্ঠানে তাকে সনদ প্রদান করা হয়। হিজরী ১২৯২ সালে তাকে মাসিক পনোরো টাকা বেতনে মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার প্রমাণ এই যে, হিজরী ১৩১৩ সালে দুর্ভিক্ষ সত্তে¡ও শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়।

মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) তার মাসিক বেতন পঞ্চাশ টাকা করেন এবং বিনা বাক্যে তিনি তা গ্রহণ করেন। অতঃপর দুইবার তিনি স্বীয় ওস্তাদকে স্বপ্নে দেখেন, স্বপ্নে তিনি বলেন, মাহমুদ, কতকাল তুমি মাদরাসা হতে মাসোহারা গ্রহণ করতে থাকবে? তাই দুই বারই তিনি মোসোহারা ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা করেন। কিন্তু মাওলানা রশীদ আহমদ তা মানেননি। তার ওফাতের পর আরেকবার শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হয়। তাই তার বেতনও বৃদ্ধি করে ৭৫ টাকা ধার্য করা হয়। কিন্তু এবার তিনি এ বর্ধিত হার গ্রহণ করেননি এবং এর পর মাদরাসা হতে বেতন গ্রহণই বন্ধ করে দেন। তিনি সারাজীবন চাটাইতে বসে শিক্ষা দান করেন। শেষ জীবনে তিনি অর্শ্বরোগের কারণে তার বসার জন্য হিতাকাক্সিক্ষদের কেউ কেউ আরামদায়ক বিশেষ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, তাতে তিনি প্রয়োজনে বসতেন, কিন্তু তাতেও কিছুটা কষ্ট হতো।

দেওবন্দ মাদরাসা কায়েম হওয়ার পর সেখানকার কোনো কোনো লোকের ধারণা হয়েছিল যে, এ মাদরাসা যখন থেকে কায়েম হয়েছে আমাদের জীবনে অভাব দারিদ্র্য নেমে এসেছে। মাওলানা যখন এ খবর অবগত হন, তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, বিষয়টি এইরূপ নয় যে, মাদরাসা তোমাদের অভাব, দারিদ্র্যের কারণ, বরং আসল কথা হচ্ছে, তোমরা পূর্বে আল্লাহর আহ্বান বা নির্দেশনাবলী অবগত ছিলে না, তখন তোমাদের পাপকর্মও ছিল হালকা, এখন যেহেতু তোমরা মাদরাসার কারণে আল্লাহর নির্দেশাবলীর প্রতি জেনেশুনে আমল করছ না, এজন্য তোমাদের প্রতি আল্লাহর আক্রোশ। তোমরা যদি আমল করো, তাহলে আবার খোশহাল হয়ে যাবে।

দারুল উলুম দেওবন্দে শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান সুদীর্ঘকাল অধ্যাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি দারুল উলুমের সদরুল মোদার্রেছীন অর্থাৎ হেড মাওলানা হিসেবে ২৪ বছর (১৮৯০-১৯১৪) দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া দারুল উলুমের সার পুরস্ত বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ১৯০৬ হতে ১৯১৪ ফের ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন।

হজরত শায়খুল হিন্দের কিছু রচনাও রয়েছে। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি হচ্ছে কোরআন শরীফের পূর্ণাঙ্গ উর্দূ অনুবাদ। শেষে অনুবাদক হিসেবে শায়খুল হিন্দ সাহেবের এক দীর্ঘ ভূমিকা রয়েছে। শুরুতে সউদী বাদশাহ মরহুম ফাহাদ ইবনে আবদুল আজীজের আরবিতে পৃষ্ঠাব্যাপী ভূমিকা রয়েছে। এ তরজমা ও তফসীরের বাংলা অনুবাদ হয়েছে বলে জানা যায়।

আসীরে মাল্টা: হিজরী ১৩৩৩ সালে হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মাওলানা মাহমুদ হাসান মক্কা শরীফে গমন করেন এবং প্রায় ছয় মাস তিনি মদীনা মোনাওয়ারায় অবস্থান করেন। এটি ছিল যুদ্ধের সময়। তার সম্পর্কে কেউ পুলিশকে জানায় যে, এ আলেমগণ ইংরেজদের গুপ্তচর এবং সিআইডি। তাই পুলিশ তাদের উত্যক্ত করতে থাকে। এ সময় তুরস্কের যুদ্ধমন্ত্রী আনোওয়ার পাশা ও নৌমন্ত্রী জামাল পাশা মদীনায় আগমন করেন। জিয়ারতের পর এসব মন্ত্রী মদীনায় সমবেত হন। প্রথমে মুফতী সাহেব বক্তৃতা করেন। অতঃপর আনোয়ার পাশা মাওলানা মাহমুদ হাসানকে বক্তৃতা করার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। অতঃপর মওলানা হোসাইন আহমদ বক্তৃতা প্রদান করেন, তাতে তিনি মাওলানা মাহমুদ হাসানের পরিচয় তুলে ধরেন। খাবারের পর মুফতী সাহেব মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, পুলিশ এমন ব্যক্তিত্বের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে। তাই তারা পুলিশকে কঠোরভাবে নিষেধ করে দেন।

হিজরী ১৩৩৪ সালে মাওলানা মাহমুদ হাসান মদীনা হতে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেখানে বোখারী শরীফের দরস শুরু করেন। হিন্দুস্থানে শরীফে মক্কার বিদ্রোহের খবর শুনে সন্দেহ ছড়িয়ে পড়ছিল। এসময় আওরঙ্গবাদের খান বাহাদুর মোবারক আলী খান মক্কা পৌছে তুর্কীদের সমালোচনা এবং শরীফে মক্কার সরকারের গুণকীর্তন করে শরীফ দরবারে প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করেছিল এবং সে নিজের সম্পর্কে একথা প্রচার করিয়ে দিয়েছিল যে, সে হিন্দুস্থান সরকারের প্রেরিত। সুতরাং একটি ফতোয়া ও ঘোষণার ব্যবস্থা করা হয়।

এ ফতোয়ায় তুর্কীদের মোলহেদ (নাস্তিক) ও কাফের আখ্যায়িত করে শরীফে মক্কার বিদ্রোহকে ন্যায় ও সঠিক বলে গণ্য করা হয়। মক্কা মোআজ্জমার উলামা সমাজ ভীত হয়ে এ ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছিলেন। এ ফতোয়া যখন খান বাহাদুরের নিকট পৌঁছে তখন সে বলল যে, ঐসব আলেমকে হিন্দুস্থানে কেউ চেনে না তবে মাহমুদ হাসান একজন বিজ্ঞ আলেম। তার স্বাক্ষর যদি হয়ে যায় তাহলে এ ফতোয়া অর্থবহ হতে পারে। শরীফে মক্কা এ প্রস্তাব পছন্দ করেন। কিন্তু মাহমুদ হাসান এ ফতোয়ায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। এভাবে মাওলানার বিরুদ্ধে সরকারকে বিভ্রান্ত করার একটি অস্ত্র হাতে এসে যায়। মাওলানা মাহমুদ হাসান ও তার সঙ্গীদের বন্দি করে মাল্টায় প্রেরণ করা হয়, যাদের মধ্যে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাওলানা আজীজ গুল, মাওলানা ওয়াহীদ আহমদ এবং মাওলানা নুসরত হোসাইন অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

আরও পড়তে পারেন-

কথিত আছে যে, মাওলানা মাহমুদ হাসানকে যখন জাহাজে তোলার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন উপস্থিত তার ভক্ত-অনুরক্তদের মধ্যে এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়, যা বর্ণনাতীত। এ সময় তার ছাত্র মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) এর যে অবস্থা হয়েছিল, তা তিনি আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে এইভাবে ব্যক্ত করেছিলেন।

‘দর্দে আয় হিজরে হযরত
কমৃতর আয় ইয়াকুবে নিসৃত
ও পিছায় গুম কারদয় হআসৃত
মান পেদার গুম কারদাহ আম।

অর্থাৎ- হজরতের বিদায় ব্যথা (আমার কাছে) ইয়াকুব (আ.) এর চেয়ে কম নয়, তিনি হারিয়েছিলেন পুত্র আর আমি হারিয়েছি পিতা। ওস্তাদের প্রতি ছাত্রের এ অনুভূতির কোনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না।

মাল্টায় জেল জীবন কীভাবে কেটেছিল তার বিবরণ হযরত মাদানী (রহ.) এর আত্মজীবনী ‘নুকুশ’ পাঠ করলে জানা যেতে পারে। শায়খুল হিন্দ হযরত মাহমুদ হাসান (রহ.) এ সময় পাঁচ বছর কারা নির্যাতনের পর মুক্তি লাভ করেন। জানা যায় যে, আওরঙ্গবাদের খান বাহাদুর মোবারক আলী খানের প্ররোচণায় তুর্কিদের বিরুদ্ধে কুফর ও নাস্তিকতার ফতোয়া রচনা করিয়ে তাতে ভীতসন্ত্রস্ত আলেমদের স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল এবং মাওলানা মাহমুদ হাসানের ওপরও চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে স্বাক্ষর করার জন্য। তিনি শরীফে মক্কার বিদ্রোহকে জায়েয ও ন্যায়সঙ্গত বলতে অস্বীকার করায় তার ও তার সঙ্গীদের ওপর জেল-জুলুম নেমে আসে। এ প্রসঙ্গে তার রেশমী রুমাল আন্দোলনের কথা এসে যায়। এ সম্পর্কে বর্ণনায় বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের পরবর্তী আলোচনা মাওলানা মাহমুদ হাসানের রেশমী রুমাল আন্দোলন।

রেশমী রুমাল আন্দোলনের নেতা হিসেবে মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে তার অপরাপর সঙ্গীসহ বন্দি করার কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অপর একটি বর্ণনা হতে জানা যায় যে, ভারত বর্ষের ইংরেজ সরকার দারুল উলুম দেওবন্দ হতে মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করে। কোনো কোনো গ্রন্থে জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ও হিন্দুস্থানে বিশেষ কর্মপন্থা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, খোদ হিন্দুস্থানে বিদ্রোহের বিশেষ প্রস্তুতিমূলক কর্মপদ্ধতির পক্ষ হতে মাওলানা উবায়দুল্লাহ (সিন্দী) কে নিয়োগ করা হয়। তাকে সে সময়ে এসব দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, তখন তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন। তিনি তার তিন বন্ধু আবদুল্লাহ, ফয়জুল্লাহ মোহাম্মদকে আলীকে সঙ্গে করে হিন্দুস্থানে আগমন করেন। মাওলানা উবায়দুল্লাহ দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষক ও ছাত্রদের সাথে মিলিত হন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করেন। তার এসব উদ্যোগের প্রতি দারুল উলুমের খ্যাতনামা আলেম মাওলানা মাহমুদুল হাসান তাকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।

এমনও বলা হয় যে, তিনি মাওলানা উবায়দুল্লাহর ডান হাত হিসেবে কাজ করেন। দারুল উলূমের প্রধান মোহতামিম (পরিচালক) মাওলানা উবায়দুল্লাহর কর্মকান্ড ও তৎপরতাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন এবং তাকে মাদরাসা হতে বহিষ্কার করেন। এবার বিদ্রোহের প্রস্তুতির সকল দায়-দায়িত্ব মাওলানা মাহমুদুল হাসানের ওপর এসে বর্তায়। প্ল্যান অনুযায়ী দেওবন্দের ছাত্রদের সমগ্র দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার এবং নির্ধারিত সময়ে বিদ্রোহ শুরু করার কথা, মাওলানা উবায়দুল্লাহ দেওবন্দ হতে প্রত্যাবর্তনের সময় মোজাহীদদের সাথে মিলিত হন এবং তাদের সতর্ক থাকতে বলেন। তিনি সেখানেই গমন করেন, সেখানে মুসলমান অধিবাসীদের মধ্যে উসমানীয় রাষ্ট্রের পক্ষ হতে প্রদত্ত জেহাদ সংক্রান্ত ফতোয়ার কপি বিতরণ করেন। প্ল্যানের মধ্যে আজীম বাগাওয়াত বা মহান বিদ্রোহের পর হিন্দুস্থানের একটি নতুন সরকার গঠন ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহিদ্র প্রতাপ নামক একজন হিন্দুর নির্বাচন অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এ সময় দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের সাথে মক্কায় আগত হিন্দুস্থানী মুসলমানদের মাধ্যমে যোগাযোগ সম্পর্ক কায়েম ছিল। মক্কায় দক্ষিণ এশিয়ার হাজীদের মধ্যে আনোয়ার পাশার পক্ষ হতে তোহফা (উপহার) হিসেবে রেশমী রুমাল পেশ করা হতো, যাতে তার সর্বশেষ নির্দেশনাবলি এবং পরিকল্পনা সংক্রান্ত শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত থাকতো। এসব হাজী সরাসরি দেওবন্দ চলে যেতেন এবং রেশমী চিঠিগুলো মাওলানা মাহমুদুল হাসানের নিকট পেশ করতেন। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান পরিচালকের সন্দেহ হয় যে, মাওলানা মাহমুদুল হাসানের মেহমান ও তার সাথে সাক্ষাৎকারীদের সংখ্যা কিছুদিন থেকে অস্বাভাবিক বেড়ে চলেছে। এতে তার সন্দেহ ঘনীভূত হয় এবং তিনি ১৯১৬ সালে ইংরেজদের কাছেও অভিযোগ পেশ করেন। সুতরাং আগস্ট মাসের এক সন্ধ্যায় মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতার করা হয়। কারণ ছিল এই যে, তার কাছে যে টাটকা রেশমী চিঠি পাওয়া যায় তাতে তার প্রতি নির্দেশ ছিল যে, তিনি কাবুলে নিযুক্ত হিন্দুস্থান বাহিনীর কমান্ডার এবং তার দায়িত্ব, তিনি দেওবন্দের ছাত্রদের সাময়িক দিক থেকে পদায়ন করবেন।

উল্লেখিত বর্ণনার মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতারের তারিখ ১৯১৬ সাল বলা হয়েছে, কিন্তু কোথায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল এবং কতদিন তিনি বন্দি অবস্থায় ছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। পক্ষান্তরে মক্কা মোআজ্জমায় তাকে শরীফে মক্কা হোসাইনের নির্দেশে বন্দি করে মাল্টার কারাগারে রাখা হয়েছিল বলে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এবং সেখানে পাঁচ বছর বন্দি ছিলেন। ভারত ও মক্কায় বন্দি হওয়ার বর্ণনা পরস্পর বিরোধী, বিষয়টি প্রশ্নবোধক হয়ে আছে। বিগত সংখ্যায় প্রকাশিত বর্ণনাটি আহমদ সাঈদ এম এ’র এবং তাহরীকে খেলাফতের বিশিষ্ট গবেষক ড. মীম কামালের।

অপর একটি বর্ণনা অনুযায়ী মাওলানা মাহমুদুল হাসান তার বিশিষ্ট ছাত্র উবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে কাবুলে প্রেরণ করেন। যাতে তিনি আফগানিস্তান ও স্বাধীন উপজাতিদের কাছ থেকে তুর্কীদের প্রতি সমর্থন আদায় করা যায়। তাকে কাবুলে প্রেরণের আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল এই যে, আফগানিস্তানকে তুর্কি ও জার্মানির ঐক্যে অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহিত করা। এর আগ থেকে আফগানিস্তানে তুর্কি ও জার্মানির বিপ্লবী প্রতিনিধিদলগুলো একই কাজ শুরু করে দিয়েছিল।

উবায়দুল্লাহ সিন্ধী ১৯১৫ সালে কাবুলে পৌঁছেন এবং সেখানে একটি অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে যাতে আমির হাবিবুল্লাহ খানকে ভারতবর্ষ আক্রমণের আহ্বান জানানো হয়, কিন্তু ইংরেজদের চালবাজির ফলে এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। অতঃপর এ অস্থায়ী সরকারের পক্ষ হতে রাশিয়া, জাপান ও তুরস্কে প্রতিনিধি দলগুলো প্রেরণ করা হয়। মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী আফগানিস্তানে জুনুদুল্লাহ নামক একটি দল গঠন করেন। কিন্তু এ সময় আফগানিস্তানে বিপ্লব ঘটায় তিনি নিজের বক্তব্যসমূহ কাপড়ে লিখে মাওলানা মাহমুদুল হাসানের নিকট প্রেরণ করতেন এবং তার অন্যান্য সহকর্মীও একই কাজ করতেন। এটি রেশমী রুমাল আন্দোলন হিসেবে খ্যাতিলাভ করে।

রেশমী রুমাল আন্দোলন ছাড়াও বিভিন্ন নামে বহু আন্দোলনই ছিল ইংরেজ বিরোধী। কেননা ইংরেজরা এদেশে শাসন ক্ষমতা সুদৃঢ় করার সাথে সাথে তুর্কী খেলাফত ধ্বংস করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং প্রথম মহাযুদ্ধের পর উঠে পড়ে লেগে যায়। এ খেলাফতকে ধ্বংস করার জন্য ইংরেজদের সৌভাগ্য এবং মুসলমানদের দুর্ভাগ্য এই যে, তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য তারা একজন শরীফে মক্কা হোসাইনের সমর্থন লাভ করে। ১৯১৬ সালের কথা। এটি যুদ্ধকালীন সময়। সে সময় খলিফার পর মুসলিম জাহানে সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে দ্বিতীয় স্তরে গণ্য হতেন শরীফে মক্কা হোসাইন। তার সম্পর্ক ছিল কোরেশ খান্দানের সাথে। ইংরেজরা তাকে উস্কে দেয় তুরস্কের বিরুদ্ধে। তিনি ঘোষণা করলেন এ বিদ্রোহে মুসলমানদের খলিফার বিরুদ্ধে নয় এ বিদ্রোহ কালো নেকড়ের বিরুদ্ধে যার পূজারী তুরাসীড়া এবং আঞ্জুমানে ইত্তেহাদে তরাকীর পাশ্চাত্যবৃন্দের বিরুদ্ধে যারা আব্দুল্লাহ জাওরাতের নীতি অনুসরণ করে চলছে যে ব্যক্তি হজরত রাসূলুল্লাহ সম্পর্কে বিদেশী ভাষায় রচিত অশ্লীলতা ও গালিগালাজে ভরা গ্রন্থাবলী তুর্কি ভাষায় অনুবাদ করেছে।

এ সময় ইংরেজরা আঞ্জুমানে ইত্তেহাদে তরক্কীর নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে প্রচারণাও শুরু করে দেয় ব্যাপকভাবে। তারা অহরহ এমন সব প্রচারপত্র বিলি-বণ্টন করতে থাকে, যাতে বলা হয় যে, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদে তরক্কীর সদস্যরা ফ্রিমেসন ও ইহুদী। এ ধরনের প্রচারপত্র রণাঙ্গণে তুর্কীদের মধ্যেও বিলি করা হতে থাকে। এগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হ্যান্ডবিলও উড়োজাহাজ হতে ইরাক ও মিসরে নিক্ষেপ করা হতে থাকে। তাদের এ প্রচারণা এতই কার্যকর ছিল যে, দানিয়াল গিরিপথের যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত মুসলমানদের মধ্যে এ ধারণা ও বিশ্বাস জন্মেছিল যে, আঞ্জুমানে তরক্কীয়ে ইত্তেহাদের বেদ্বীন নেতারা খলিফাকে অন্তরীণ করে রেখেছে এবং তারা তাকে রক্ষা করার জন্য মূল ও নৌ আক্রমণে অংশগ্রহণ করছে।

ইংরেজদের প্রচারণা ব্যর্থ করে দেয়ার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহার এবং তার সহ লেখকবৃন্দ। কিন্তু ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব করেনি। তারা আলী ভ্রাতৃদ্বয় ও অন্য তুর্কীদের সমর্থনে লেখনী চালানোর অভিযোগে কারাগারে নিক্ষেপ করে এবং প্রচারধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোতে তালা ঝুলিয়ে দেয়। রণফ্রন্টে যেসব হিন্দুস্থানী মুসলমান কমান্ডারদের নির্দেশ অমান্য করতো এবং অস্ত্র ত্যাগ করতো তাদের ফাঁসিতে ঝুলানো হতো। ফাঁসি দেওয়ার জন্য যে রশি ব্যবহার করা হতো তা, শুকরের চামড়া দ্বারা তৈরী করা হতো। যেহেতু মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী শুকর হারাম, তাই সাধারণ লোকের ধারণা ছিল, যে মুসলমান শুকরের রশি দ্বারা ফাঁসিতে ঝোলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অর্থাৎ ইংরেজরা হিন্দুস্থানী মুসলমানদের জীবন অতিষ্ট করে তোলার জন্য এসব আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। এসব ছাড়া ও গদর বা বিদ্রোহের নামে যে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল, সবগুলো ইংরেজরা দমন করে ফেলে এবং এসব আন্দোলনের প্রায় দুইশ নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে ফাঁসিতে ঝুলায়।

মাওলানা মাহমুদুল হাসান উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমই ছিলেন না, তিনি ছিলেন, অত্যন্ত দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও তার নিকট মুসলিম বিশ্বের চলমান পরিস্থিতি ছিল স্পষ্ট। বিশেষতঃ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তার, মুসলমানদের ওপর উৎপীড়ন-নির্যাতন, তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র ইত্যাদির প্রতি তার তীক্ষè দৃষ্টি ছিল। তাই কর্ম জীবনের শুরুতেই তিনি সুচিন্তিত কর্মপদ্ধতি স্থির করে রেখেছিলেন। তা বাস্তবায়নের কাজ তখনই আরম্ভ করেছিলেন, যখন সমগ্র মহাদেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নামেমাত্র শুরু হয়েছিল বিশেষভাবে তিনি ভারতবর্ষ ও তুরস্কের ঘটনাবলীকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রেখেছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার এবং তাতে তুর্কীদের অংশগ্রহণ করার যেসব ঘটনা ঘটে চলছিল, তাতে মাওলানা মাহমুদুল হাসান বাধ্য হয়েছিলেন তার উদ্যোগ-প্রয়াসগুলোকে আরো সম্প্রসারিত করতে। তার প্রাথমিক তৎপরতাগুলো ইংরেজদের দৃষ্টিতে ছিল। তাই তিনি হিন্দুস্থান থেকে হেজাজ যাত্রা করেন। সে সময় তুর্কীদের পক্ষ হতে গালেব পাশা তুর্কীর অধীনস্থ হেজাজের গভর্নর ছিলেন।

মাওলানা মাহমুদুল হাসান তার সাথে একাধিকবার মিলিত হন এবং তার কাছ থেকে মহাদেশের মুসলমানদের নামে বাণী লাভ করেন। এ সময় তুর্কী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আনোয়ার পাশার সাথেও তার সাক্ষাৎ হয়। আনোয়ার পাশা হিন্দুস্থানের পূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তুরস্কের পক্ষ হতে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন এবং আনোয়ার পাশাও হিন্দুস্থানী মুসলমানদের নামে বাণী প্রেরণ করেন। এসব রচনায় ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানদের জেহাদ তুর্কীর পক্ষ হতে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে গালেব নামা নামে খ্যাত চিঠিখানার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা মহাদেশে প্রেরণ করা হয় এবং হিন্দুস্থান ও সীমান্ত উপজাতিদের মধ্যে গোপনে বিলি করা হয়, কিন্তু ইংরেজরা সতর্ক থাকায় জেহাদের এ ঘোষণাপত্রের মাত্র কিছু কপি বিলি করা হয়েছিল। গালেব নামা তথা ঘোষণাটি ছিল এই: এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার মুসলমানগণ সর্ব প্রকার অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আল্লাহর পথে জেহাদের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। আল্লাহ কাদের কাইয়ুমের শোকর তুর্কী বাহিনী এবং মোজাহেদীন ইসলামের দুশমনদের ওপর জয়ী হয়েছে। এজন্য হে মুসলমানগণ, এ খ্রিস্টান সরকারের ওপর আক্রমণ করো, যার বন্ধনে তোমার পড়ে রয়েছে। নিজেদের সমস্ত উদ্যোগ-প্রচেষ্টাকে সুদৃঢ় সংকল্পের সাথে শত্রুকে খতম করার জন্য উৎসর্গ করো এবং তাদের প্রতি ঘৃণা ও শত্রুতা প্রকাশ করো।

পরিশেষে বলে রাখা দরকার যে, মাওলানা মাহমুদুল হাসান একজন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, মোহাদ্দেস, মোফাসেসর ও সাধক হওয়ার পাশাপাশি উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক ছিলেন। তিনিই ইংরেজদের কবল থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মুক্ত করার জন্য এক অভিনব কৌশল রেশমী রুমাল আন্দোলন করতে গিয়ে তার শেষ জীবনের পাঁচ বছর কারা নির্যাতন ভোগ করেন। তার এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বানচাল করাও ছিল অন্যতম। তার এ আন্দোলন-সংগ্রামের প্রভাব তুর্কিদেরও আলোড়িত ও প্রভাবিত করেছিল, যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তুর্কি নেতৃবৃন্দের সাথে তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের সমর্থন লাভ। ১৯২০ সালের ৮ জুন পাঁচ বছর জেলজুলুম ভোগ করার পর আসীরে মাল্টা নামে খ্যাত হয়ে মুক্তি লাভ করেন। বাকি কমাসও তার নানাকর্ম তৎপরতা থেমে থাকেনি এবং একই বছর তিনি ৩০ নভেম্বর (মতান্তরে) ৩ নভেম্বর তিনি ইনতেকাল করেন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।