Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন মুসাফাহা ও মুয়ানাকায় প্রচলিত কিছু ভুল প্রথা

মুসাফাহা ও মুয়ানাকায় প্রচলিত কিছু ভুল প্রথা

।। আল্লামা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী ।।

মুসাফাহা এবং মুয়ানাকা পর্যায়ক্রমে সালামের পরিশিষ্ট। সুতরাং সালামের আগে অথবা সালাম ব্যতীত মুসাফাহা এবং মুয়ানাকার কোন বিধান নেই। তাই এমনটা যারা করছেন, তারা অজ্ঞতা বশত আরেক মনগড়া কাজের প্রচলন করে যাচ্ছেন। সালাম করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ বা বাধ্যতামূলক সুন্নাত এবং এর জবাব দেয়া ওয়াজিব। এতদসত্ত্বেও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সালাম করা নিষেধ এবং তার জবাব দেয়া ওয়াজিব নয়। অথচ মুসাফাহা ও মুয়ানাকা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ্ বা বাধ্যতামূলক নয়, বরং এ দুটি হচ্ছে সুন্নাতে যায়েদা বা ঐচ্ছিক্য সুন্নাত। সুতরাং এদু’টি কাজের বেলায় আরও সতর্ক থাকা দরকার যে, তা যথোপযুক্ত সময়েই করা হচ্ছে, না অসমীচীন অবস্থায় করা হচ্ছে।

আজকাল অনেক লোক এমনও পাওয়া যায়, যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চলন্ত যানবাহনের যাত্রীর হাত ধরে ফেলেন মুসাফাহা করার জন্য। আরেক ব্যক্তির যানবাহন ছেড়ে দিচ্ছে বলে সে তাড়াহুড়া করছে যানবাহনে আরোহনের জন্য, এমতাবস্থায়ই আরেকজন তাকে জড়িয়ে ধরেন মুয়ানাকা করার জন্য। কি অদ্ভুত এদের বিবেক। সংসারের সকল কাজের সময়োপযোগিতা বুঝেন, কিন্তু ধর্মীয় কাজের বেলায় এমন কা-জ্ঞানহীন বোকা সেজে বসেন! কাজেই মুসাফাহা-মুয়ানাকার সময়োপযোগিতা বুঝার জন্য পূর্ব থেকেই ইসলামী শরীয়াতের কয়েকটা মৌলিক বিধান স্মরণ রাখতে হবে।

আর তা হচ্ছে শরীয়তের বিধানে মুসাফাহা-মুয়ানাকা যেহেতু বাধ্যতামূলক নয়, তাই এগুলি করলে সাওয়াব হবে, কিন্তু না করলে কোন গুনাহ্ হবে না। পক্ষান্তরে করতে গিয়ে কাউকে কষ্ট দিলে, অথবা কারো সংসারের কাজের ক্ষতি করলে, অথবা কারো কোন প্রকার ধর্মীয় কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতঃ মুসাফাহা অথবা মুয়ানাকা করতে গেলে অবশ্যই গুনাহ্ হবে। সুতরাং অতিরিক্ত সাওয়াবের কাজ করতে গিয়ে গুনাহ্ করে বসা কতো বড় বোকামী তা বলারই অপেক্ষা রাখে না। নিম্নে এর কতিপয় উদাহরণ আমার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে পেশ করছি-

কাপড় পরিধানের সময় মুসাফাহা

আমি নিজে প্রায় সময় এমন সমস্যাতেও পড়ি যে, দু’হাতে লুঙ্গি পরিধান করছি এমতাবস্থায় আমার কোন ভক্ত হাত বাড়িয়ে দেন মুসাফাহা করার জন্য। কি আশ্চর্য! শুধু তাই নয়, বরং এমন এক ভক্তকে আমি বললাম, আমাকে লুঙ্গিটা পরে নেয়ার অবকাশ দিন। জবাবে ভক্তটি বলে লুঙ্গিতো পরেও পড়তে পারবেন। আমি বললাম, তবে কি খোলা লুঙ্গিটা এখন হাত থেকে ছেড়ে দেব? তখন আর কোন কথা বলে না, শুধু হাসে।

এত কা-জ্ঞানহীন মানুষ হতে পারে, তা ভাবতেও অবাক লাগে। অনুরূপভাবে জামা গায়ে দেয়ার সময়, পায়জামা পরিধানের সময়, পাগড়ী বাঁধার সময়, জুতার ফিতা বাঁধার সময় অনেককেই হাত বাড়িয়ে মুসাফাহার জন্য পীড়াপীড়ি করতে দেখা যায়। চিন্তা করা উচিত যে, এ সামান্য কাজ থেকে অবসর হতে মাত্র দু’এক মিনিট সময়ের ব্যাপার। তার পরেই কি মুসাফাহা করা উচিত নয়? অগত্যা মুসাফাহাকারীর যদি এতই ব্যস্ততা থাকে যে দু’এক মিনিট সময়ও সে মুসাফাহার অপেক্ষায় থাকতে পারবে না, তখনই তো বিবেক খাটানোর দরকার যে, মুসাফাহা না করে চলে গেলে গুনাহ্ হবে, না লুঙ্গি পরিধানকারী ব্যক্তির খোলা লুঙ্গিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য করলে গুনাহ্ হবে।

পিছন দিক থেকে সালাম-মুসাফাহা

অনেককেই পিছন দিক থেকে সালাম করতে এবং মুসাফাহার চেষ্টা করতে দেখা যায়। অথচ সাক্ষাতের সালামটা সামনাসামনি অবস্থায় করাই সুন্নাত। কাউকে তার পিছন দিক থেকে সালাম করা ধর্মীয় দিক থেকে যেমন সুন্নাত নয়, তেমনি বিবেকের দিক থেকেও সমীচীন নয়। কারণ কাউকে তার পিছন দিক থেকে সালাম করলে সে কেমন করে বুঝবে যে, কে সালাম করছে এবং কাকে সালাম করছে? আর কাকে সালাম করা হচ্ছে তাই না বুঝলে সালামের জবাব দেয়ার দায়িত্ব বর্তাবে কার উপর? এছাড়া এ সালামের উপলক্ষ্যই তো সাক্ষাত। আর সাক্ষাত কি পিছনে থাকলে হয়, না সামনে গেলে হয়, এটা বুঝাতো খুব তীক্ষ্ম বিবেকের ব্যাপার নয় বরং সাধারণ বিবেকের দ্বারাই বুঝা যায়।

আরও পড়তে পারেন- সালাম-কালামের আদব-কায়দা

আর কারো পিছন দিক থেকে তার সাথে মুসাফাহার চেষ্টা করা আরও চরম বোকামী। শুধু বোকামীই নয়, আদবের পরিপন্থীও বটে। কারণ একজনের পিছন দিক থেকে তার সাথে মুসাফাহার চেষ্টা করার সরল মর্ম সাধারণতঃ এটাই দাঁড়ায় যে, আমি আপনার সামনে যাওয়ার কষ্টটুকু স্বীকার করব না। বরং আপনি আমার দিকে ফিরে আমার সাথে মুসাফাহা করুন। এটা কি যার সাথে মুসাফাহা করার চেষ্টা করা হচ্ছে তার সাথে আদব হল? আর বোকামীর কারণ হচ্ছে আপনি যার পিছন দিক থেকে মুসাফাহা করতে চাচ্ছেন, তিনি তো আপনার সামনে আছেন। তাই আপনার হাত মুসাফাহার জন্য সামনের দিকে বাড়াতে পারছেন। কিন্তু আপনি নিজে তো তার পিছনে। তাই আপনার সাথে তার মুসাফাহা করতে হলে হয়ত তাকে আপনার দিকে ফিরতে হবে। কিন্তু মুসাফাহার জন্য আপনার দিকে ফিরার মত অনুকূল অবস্থা তার আছে কিনা, সেটা তো আপনি তার চেয়ে অধিক জানেন না।

যদি তার ফিরার মত সুযোগ না থাকে, তাহলে তাকে আপনার সাথে মুসাফাহা করার জন্য পিছনের দিকেই হাত বাড়াতে হবে।

আর সাধারণতঃ মুসাফাহার জন্য যেহেতু প্রথমে ডান হাতই বাড়াতে হয়। তাই এখন তার পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে, হয়তো তার ডান হাত ডান পাশ দিয়ে পিছন দিকে বাড়াবেন, আর না হয় বাম পাশ দিয়ে পিছন দিকে বাড়াবেন। অথচ ডান হাত ডান পাশ দিয়ে এমনভাবে বাড়াবার উপায়ই নেই যেভাবে বাড়ালে পিছনের লোকটার হাতে ধরে মুসাফাহা করা যায়। আর বাম পাশ দিয়ে ডান হাত পিছনে বাড়ালে নিজের শরীরটা হাতের বেষ্টনিতে পড়ায় এ হাত দিয়েও পিছনের লোকটার হাত নাগাল পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

সুতরাং পিছন দিক থেকে মুসাফাহার চেষ্টা করা চরম বোকামী। এতো কথা বলারও দরকার পড়েনা তাদের জন্য, যারা একটা কথা স্মরণ রাখতে পারেন যে, মুসাফাহা পিছন দিক থেকে করা সুন্নাত নয়, বরং সামনের দিক থেকে করা সুন্নাত। আপনার যদি ঐ ব্যক্তির সামনে যাওয়ার সুযোগ না থাকে, তাহলে আপনাকে কে বলল একটা ঐচ্ছিক সাওয়াবের কাজের জন্য একজনকে বিভিন্ন উপায়ে কষ্ট দিয়ে গুনাহের পথ প্রশস্ত করার জন্য?

অনেক সময় পরিস্থিতি এমনও দাঁড়ায় যে, একজন ওয়ায়েয বক্তব্য রাখার জন্য মঞ্চে হাতা বিশিষ্ট চেয়ারে বসেছেন। এমতাবস্থায় মঞ্চের পিছনে উপবেশনকারীদের অনেকেই চেয়ারে উপবিষ্ট ওয়ায়েযের পিঠে আঙ্গুল দিয়ে গুতো দেন। তিনি যখন গুতো খেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকালেন, তখন তারা পিছন থেকেই তাঁর সাথে মুসাফাহার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। এ অবস্থাটা যে কত মারাÍক, বিব্রতকর ও কষ্টকর তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যকে বুঝাবার ভাষাই আমার জানা নেই। অথচ এহেন কষ্টকর ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাদের সাথে মুসাফাহা না করলে তারা দুঃখিত হন এবং অহংকারের অভিযোগ উত্থাপন করেন। অথচ তাদের বুঝা উচিত ছিল যে, এ পরিস্থিতির মধ্যে তাদের মুসাফাহা না করলেও কোন গুনাহ হত না। কিন্তু মুসাফাহার জন্য একজনকে এমনভাবে কষ্ট দিলেও কি গুনাহ্ হবে না? শরীয়তের বিধানে অন্যায়ভাবে কাউকে কষ্ট দেয়াই তো গুনাহের কাজ।

হাত অবসর না থাকাবস্থায় মুসাফাহা

অনেককে দেখা যায়, যার সাথে মুসাফাহা করতে যাচ্ছেন তার হাত অবসর না থাকলেও হাতের কাজ ফেলে দিয়ে তাকে মুসাফাহা করতে বাধ্য করেন। এটাও আরেক বিবেকহীন কা-। হাঁ কেউ স্বেচ্ছায় হাতের কাজ ছেড়ে মুসাফাহা করতে গেলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এভাবে কাউকে হাতের কাজ ছাড়তে বাধ্য করা উচিত নয়। এটা অনেক সময় মারাত্মক বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে একটা উদাহরণ পেশ করছি।

আরও পড়তে পারেন-

বৃষ্টির দিন ছিল। আমার এক হাতে ব্যাগ এবং অপর হাতে ছাতা ধরে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। কোন এক হাতও অবসর না থাকায় বৃষ্টির পানি থেকে শরীরের পোষাক ঠিকমত বাঁচাতে পারছিনা। এমতাবস্থায় একাধারে বেশ কয়েকজন এক হাতে নিজের ছাতা ধরে অপর হাত আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়েছেন মুসাফাহা করার জন্য। কি অদ্ভুত তাদের বিবেক! এমনিভাবে অনেক সময় অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতি দাঁড়ায়। যেসব অবস্থায় কোন একটি হাতও অবসর থাকে না। কিন্তু তখনও অনেক বেখেয়াল বন্ধুরা মুসাফাহা করার জন্য বাধ্যতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। অথচ তাদের বুঝা উচিত ছিল যে, মুসাফাহা করা জরুরী, না কাউকে অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে ফেলা থেকে বিরত থাকা জরুরী।

স্মরণ রাখা উচিত যে, মুসাফাহার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যদি মুসাফাহা না করা হয়, তবুও গুনাহ্ হবে না। যেহেতু এটাকে শরীয়তের বিধানে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। কিন্তু কাউকে অসুবিধায় ফেলে কষ্ট দেয়া নিশ্চই গুনাহের কাজ।

ভীড়ের মধ্যে মুসাফার চেষ্টা

অনুরূপভাবে অনেককেই প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যেও মুসাফাহা করার জন্য অস্থির হয়ে পড়তে দেখা যায়। এ অবস্থায় আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে দু’একটা উদাহরণ পেশ করছি।

রেল গাড়ীর টিকেট কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি। এ লাইনের ভীড়ের প্রচ-তা ও ধাক্কা-ধাক্কির অবস্থা ভুক্তভোগীরাই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। এমতাবস্থায় আমার এক হাতে ব্যাগ আরেক হাতে টিকেটের টাকা নিয়ে কোন রকমে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ আমার অলক্ষ্যেই এক ব্যক্তি আমার ডান হাতে টাকাসহ তার দু’হাতের মুঠোয় পুরে চাপ দিচ্ছে। মুহর্তে আমার মনে হল কোন ছিনতাইকারী হয়ত হাতের টাকাগুলো ছিনিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু চেয়ে দেখি তা নয়। বরং এক ব্যক্তি ভক্তির আতিশয্যে অধীর হয়ে মুসাফাহা করছে। কি অদ্ভুত ভক্তি!

প্রায় সময়ই অনেকে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে, বিশেষ কোন জরুরী কাজে যাওয়ার সময় রাস্তায় লোকের ভীড়ের কারণে যখন পথ চলাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তখনও দু’দিক থেকে দু’হাত ধরে তারা রীতিমত টানা-হেঁচড়া শুরু করে দেয় মুসাফাহা করার জন্য। শুধু তাই নয়, বরং অনেকেই পিছন থেকে আমার হাত ধরে হেচকা টান মেরে আমাকে পিছনের দিকে ঘুরিয় ফেলেন। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করি, কি ব্যাপার? উত্তরে বলেন, মুসাফাহা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লোকের ভীড়ের কারণে আপনি দেখেননি। তাই একটু চেষ্টা করেই মুসাফাহাটা করে নিলাম। কী অদ্ভুত মুসাফাহা! আল্লাহ্ এ সকল বেদিশা বন্ধুদের দিশা দান করুন।

আবার অনেকেই মুসাফাহার জন্য ভীড়ের সৃষ্টি করেন। কোন সমাবেশে বিশেষ কোন মেহমান আসলে শত শত ভক্তরা আগন্তুককে ঘিরে ফেলেন তার সাথে মুসাফাহা করার জন্য। এদের মধ্যে এমন কা-জ্ঞান সম্পন্ন লোকের বড়ই অভাব, যারা ভেবে দেখবেন যে, আগন্তুক মেহমানের দীর্ঘ পথ অতিক্রমসহ সফরের সীমাহীন ক্লান্তি নিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আগেই এতোসব লোকের সাথে মুসাফাহায় লিপ্ত হওয়া তার জন্য কত কষ্টকর। অনেক সময় তো ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মেহমানকে বিশ্রামের স্থলে পৌঁছানোর আগেই শতশত লোক রাস্তা বন্ধ করে ঘিরে ফেলে মুসাফাহার জন্য। পরিস্থিতির জটিলতাকে একবার নিজের বেলায় চিন্তা করে দেখলেই হয় যে, আমাকে যদি এমন ক্লান্ত অবস্থায় এতোসব লোকের সাথে মুসাফাহা করার জন্য পথ রুদ্ধ করতঃ আটকে ফেলা হত, তখন আমার কী পরিমাণ কষ্ট হত?

অনেকে আবার ভীড়ের কারণে নাগালে না পেয়ে দূর থেকেই হাত বাড়িয়ে মুসাফাহার জন্য ডাকতে থাকেন। আরে ভাই! যে ভীড়ের কারণে আপনি নিজেই আসতে পারছেন না, সে ভীড় অতিক্রম করার জন্য আরেকজনকে আহ্বান করেন অথবা হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করেন কোন বিবেকে? মুসাফাহা করাটা জরুরী, না কাউকেএমন কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা জরুরী?

আবার মেহমানের বিদায়ের সময় দেখা যায়, অনেক লোকেরা ভীড় করে রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে মুসাফাহা করার জন্য। আসার সময়ও ঘরে পৌঁছার আগেই রাস্তা বন্ধ করে ভীড় জমায়, আবার যাওয়ার সময়ও ঘরের বাইরে ভীড় জমিয়ে রাস্তা বন্ধ করে ফেলে। এ উভয় অবস্থা মেহমানের জন্য অত্যন্ত বিরক্তিকর।

নামাযের পরে মুসাফাহা

মুসাফাহার বাড়াবাড়ি সীমা লংঘন করতে করতে আজকাল এক পর্যায়ে বিদ্আতে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন নামাযের সালামান্তে মুসাফাহা। আজকাল অনেকেই নামাযের সালাম ফিরিয়ে ডান-বামের মুসল্লীদের সাথে মুসাফাহা করেন। কেউ কেউ সমস্ত মুসল্লীদের সাথে মুসাফাহায় লিপ্ত হয়ে যান। অথচ নামাযের সালামের পরে মুসাফাহা করা বিদ্আত। (দ্রঃ মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরকাতের বরাতে মাসায়েলে ইমামত)।

একদা আমি জামাতের সাথে নামায পড়ছিলাম। ইমাম সাহেবের সাথে সমবেত মুসল্লীরা সালাম ফিরাবার সাথে সাথেই এক ব্যক্তি তার অপর পাশের মুসল্লীদের সাথে মুসাফাহা করতঃ আমার দিকেও হাত বাড়িয়ে দিল। আমি বললাম, এখনকার মুসাফাহা সুন্নাত নয়, বিদআত। এতে লোকটা আমার প্রতি ভীষণভাবে চটে গিয়ে বলল, মুসাফাহা করা তো সাওয়াবের কাজ। এটা বিদআত হবে কেমন করে। অথচ বিদআত হচ্ছে গুনাহের কাজ। কি অদ্ভুত যুক্তি! অথচ ইসলামী শরীয়তের বিধানে যখন যে কাজ যেভাবে করলে সাওয়াব হবে বলে উল্লেখ নেই, তখন সে কাজ সেভাবে সাওয়াবের আশায় করার নামই তো বিদ্আত। এ মর্মে নিুোক্ত ঘটনা প্রণিধানযোগ্য। একদা এক ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে ঈদগাহে নফল নামায পড়তে চেয়েছিল। হযরত আলী (রাযি.) তাকে বাঁধা দিলে লোকটি বলল, হে আমীরুল মু’মিনীন! আমি জানি নামায পড়ার কারণে আল্লাহ্ কাউকে শাস্তি দিবেন না। উত্তরে হযরত আলী (রাযি.) বলেন, যে নামায রাসূলের তরীকায় স্বীকৃত নয়, সে নামাযই আল্লাহ্ প্রদত্ত শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। (দ্রঃ মাজালেছুল আবরার এর বরাতে মাসায়েলে ইমামত)।

সুতরাং যে কাজ সাওয়াবের উদ্দেশ্যে করা হয়, অথচ এ কাজটি এ সময়ে অথবা এভাবে করা ইসলামী বিধানে সমর্থিত নয়, এমন কাজকেই ইসলামের পরিভাষায় বিদ্আত বলা হয়। যে কাজ মূলতই সাওয়াবের উদ্দেশ্যে করা হয় না, তা আর যাই কিছু হোক, কিন্তু বিদআত হতে পারে না। সুতরাং নামাযের সালামান্তে মুসাফাহা মুয়ানাকা বিদ্আত। এমন বিদয়াতীদেরকে ধমক দিয়ে বারণ করা দরকার। এতেও বিরত না হলে শাস্তি দিয়ে বারণ করার বিধান আছে। (দ্রঃ ফাতওয়ায়ে শামীর বরাতে মাসাইলে ইমামত)

ঈদের দিন মুসাফাহা-মুয়ানাকা

আমাদের সমাজে ঈদের মিলন নামে আরেক বিদআতের প্রচলন হয়ে গেছে। আর তা হচ্ছে ঈদের নামাযান্তে মুসাফাহা ও মুয়ানাকা এবং এর বাড়াবাড়ি এতই চরমে গেছে যে, কথিত এ ঈদের মিলনে যদি আপনি অংশগ্রহণ করতে না চান, তাহলেই দেখবেন, আপনার প্রতি ভর্ৎসনার ঝড় কেমন গতিতে ধেয়ে আসে। অথচ ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা ঈদের মিলনও নয়, সুন্নাতও নয় বরং বিদআত। (মাসাইলে ইমামত)।

ইসলামী শরীয়তে ঈদের মিলনের ব্যবস্থা হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে সম্মিলিত নামায এবং নামাযান্তে খুতবা। ঈদের নামায পড়া ওয়াজিব। এর খুত্বা পড়া সুন্নাত, কিন্তু তা শোনা সমবেত সকলের জন্য ওয়াজিব। অথচ অনেকেই ঈদের নামাযের পরে খুত্বা শোনার জন্য বসতে নারাজ। কেউ কেউ বসলেও মনযোগে খুতবাটুকু শোনার মত ধৈর্য ধারণ করতে নারাজ। কিন্তু কেন? ইসলামী শরীয়তে ঈদ উপলক্ষে মিলনের যে ব্যবস্থা ছিল তাতে এতো উদাসীন কেন? এর পরিবর্তে মনগড়া “ঈদ মিলনের” প্রচলন কেন?

বিদআতীদের স্বভাব

বিদআতীরা নিজেদের কৃত বিদ্আতকে শরীয়ত সম্মত সাব্যস্ত করার জন্য ইসলামী আইনের ফাঁক ফুকড় অবলম্বনে নানা ধরণের অপব্যাখ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এটা তাদের চিরাচরিত স্বভাব। এ স্বভাবের একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঈদের নামাযান্তে মুসাফাহা মুয়ানাকার প্রচলনের শ্রোতে ভেসে গিয়ে তারা বলে যে, শরীয়তে কি এ সময়ে মুসাফাহা-মুয়ানাকা করা নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ আছে? কি অদ্ভুত দলীল!

কোন কাজ কখন কিভাবে করলে সাওয়াব হবে, তা অবশ্যই শরীয়ত তথা ইসলামী বিধান শা¯ে উল্লেখ আছে। ইসলামী বিধানকে উপেক্ষা করতঃ মনগড়াভাবে কোন সাওয়াবের কাজ করতে যাওয়াই বিদআত বলে শরীয়তে উল্লেখ আছে।

ইসলামী বিধান বলে, পারস্পরিক সাক্ষাৎ উপলক্ষে যে সালামের আদান প্রদান হয়, সেই সালামের অধীন হচ্ছে মুসাফাহ ও মুয়ানাকা। যে সালাম নামাযের অঙ্গ, সেই সালামের অধীনে মুসাফাহা মুয়ানাকা নেই। (মাসাইলে ইমামত)। সুতরাং যেখানে যেটা নেই সেখানে সেটাকে টেনে নেয়াই তো বাড়াবাড়ি ও কুসংস্কার।

বিদ্আতীদের চুড়ান্ত যুক্তি

শেষ পর্যন্ত বিদ্আতীগণ এ যুক্তির আশ্রয় নিয়ে থাকে যে, ঈদগাহ থেকে বিদায় হওয়ার পথে যদি কারো সাথে সাক্ষাৎ হয়, তবে কি তার সাথে সালাম-মুসাফাহ ইত্যাদি করব না? কি বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্ন! কথা ছিল সালাম-মুসাফাহার উপলক্ষ্যই হচ্ছে সাক্ষাৎ, ঈদের নামায নয়। সুতরাং যে কোন সময় নুতনভাবে সাক্ষাৎ হলে যেভাবে সালাম মুসাফাহা চলবে, ঈদগাহ্ থেকে ফিরার পথেও কারো সাথে নতুনভাবে সাক্ষাৎ হলে একইভাবে সালাম-মুসাফাহা চলবে। সুতরাং এটার উপলক্ষ্য ঈদের নামায নয় এবং এর নাম ঈদের মিলন নয়। এর সাথে ঈদ নামাযান্তে আলিঙ্গনের হিড়িকের সামান্যতম সামঞ্জস্যও নেই।

আরেকটা বিদ্আত চালু হওয়ার পথে

আজকাল অনেকের মধ্যে আরেকটা বিদ্আতের পাঁয়তারা চলছে। আর তা হচ্ছে, ঈদের নামায শেষে ঈদগাহ থেকে বিদায়ের পথে দল বেঁধে গোরস্থানের যিয়ারত। শরীয়তের বিধানে গোরস্থানের যিয়ারত একটা সাওয়াবের কাজ। ঈদের দিন যিয়ারত উত্তমও বটে। কিন্তু ঈদের নামাযান্তে কবর যিয়ারতকে জরুরী মনে করা বিদ্আত।

অথচ এ পর্যন্ত আমি কয়েক স্থানে প্রত্যক্ষ করেছি যে, ঈদ নামাযান্তে কবর যিয়ারতকে শুধু যে জরুরী মনে করা হয় তাই নয়, বরং যিয়ারতের জন্য এভাবে ডাকা হয় যে, “শ’ দিনের একদিন মুর্দাগণ আমাদের দিকে চেয়ে আছে। তাই যিয়ারত না করে কেউ যাবেন না”। মুর্দাদের প্রতি কি আশ্চর্য দরদ! তারা কি শ’দিনের একদিনই মাত্র চেয়ে থাকে? অন্যদিন কি আমাদের কাছ থেকে মুর্দাগণের পাওয়ার মত কিছু নেই? কাজেই ঈদের দিনে এত গুরুত্বপূর্ণভাবে যিয়ারতের দাওয়াত কেন? শুধু তাই নয় বরং কোথাও কোথাও ঈদ নামাযের পরে কবর যিয়ারত না করে কেউ চলে গেলে তাকে নিন্দা ও ভর্ৎসনা করা হয়। কতো জঘন্য বাড়াবাড়ি এটা!

[পরের কিস্তিতে সমাপ্য]

– আল্লামা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখ্যাত মুফাসসীরে কুরআন ও ইসলামী স্কলার।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।