Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাকিস্তানের রাজনৈতিক নাটকের মূল চালক যখন শীর্ষ জেনারেলদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা

পাকিস্তানের রাজনৈতিক নাটকের মূল চালক যখন শীর্ষ জেনারেলদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা

তিলক দেবশ্বর: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছেন শাহবাজ শরীফ। প্রধানমন্ত্রী হতে না হতেই শাহবাজকেও তার পূর্বসূরিদের ভাগ্য বরণ করতে হবে কি না, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। দেরিতে হলেও পাকিস্তানের সর্বাধিক ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী বুঝতে পেরেছে, দেশচালনার জন্য তারা একজন অযোগ্য ব্যক্তিকে ‘নির্বাচন’ করেছিল। দেশের অর্থনীতি কিংবা সুশাসন- কোনো ক্ষেত্রেই তিনি অবদান রাখতে পারেননি। আর এই সবকিছুই পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক দুরবস্থার জন্য দায়ী।

তারপরও ২০২৩ সালের পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সেনাবাহিনী অপেক্ষা করতে পারত। কিন্তু ইমরান খান যখন নিজের জনপ্রিয়তায় বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, তখনই ভুলটা হলো। যে শক্তি তাকে দুধকলা দিয়ে পুষে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, তাদেরই তিনি ছোবল দিয়ে বসলেন।

২০২১ সালের অক্টোবরে ইমরান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা- আইএসআই এর ডিজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদকে পেশোয়ারের কর্পস কমান্ডার হিসেবে বদলি করতে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া-র পদক্ষেপ প্রতিহত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। ইমরান চেয়েছিলেন, হামিদকে ডিজি আইএসআই পদে রাখতে, যাতে হামিদ তাকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করতে পারেন। অন্যদিকে, জেনারেল হামিদের ইচ্ছা ছিল বাজওয়ার উত্তরাধিকারী হওয়ার। আর ইচ্ছাপূরণে ইমরান তাকে সাহায্য করবেন- এমনটাই ছিল তার প্রত্যাশা। কিন্তু, বাজওয়া যিনি তৃতীয় মেয়াদে সেনাপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল এসব ঘটনা।

শেষ পর্যন্ত ইমরান সরে দাঁড়ান। ধারণা করা হয়, পেশোয়ার থেকে হামিদ এরপর ইমরানকে বিভিন্ন কৌশলে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছিলেন। কোনো রাজনীতিবিদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করাকে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভালো চোখে দেখে না সেনাবাহিনী। শেষ অবধি ঘটনাটি তাদের সহ্যের শেষ সীমায় নিয়ে যায়।

২০১৮ সালে ইমরানকে ক্ষমতায় বসানোর পর থেকেই, তিনি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষা ও প্রয়োজনীয় আইন পাস করার মতো শাসনতান্ত্রিক রাজনীতিক শক্তির জন্য সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করছিলেন। কিন্তু, সেনাবাহিনী তাকে বাদ দিয়ে হঠাৎ করেই ‘নিরপেক্ষ’ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, হামিদও আর আইএসআই ডিজি না থাকায় তালগোল পাকাতে শুরু করেন ইমরান।

পাকিস্তানের পাঞ্জাবের একজন রাজনীতিক বিষয়টি দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেন, ন্যাপি (ডায়াপার) পরিবর্তনের জন্য ইমরান অন্যদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলেন, যে তিনি নিজে থেকে তা করতে শিখেননি! এটা আশ্চর্যজনক নয়। ইমরান তার অধিকাংশ মিত্র, এমনকি পিটিআই-এর অনেককেও ধরে রাখতে ব্যর্থ হন।

আরও পড়তে পারেন-

সেনাবাহিনীর এই ‘নিরপেক্ষতা’ টের পেয়ে বিরোধীরা তাদের চাল চালে। মার্চের শুরুতে, জাতীয় পরিষদে ইমরানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় অনাস্থা প্রস্তাব (এনসিএম)। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর বিষয়টি বুঝতে পেরে, ইমরান ক্ষমতায় থাকার জন্য বিপজ্জনক, প্রশ্নবিদ্ধ ও অসাংবিধানিক সব পদক্ষেপ অবলম্বন করেছিলেন। তার অহংকার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, গণতান্ত্রিক পরাজয়ও স্বীকার করতে পারেননি। ফলস্বরূপ; তিনি এমন এক সাংবিধানিক সংকট তৈরি করেন- যার প্রতিক্রিয়া হতে পারত মারাত্মক।

ইমরান অভিযোগ করেন, ‘স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি’ অনুসরণের জন্য তাকে আমেরিকা সমর্থিত শক্তি পদচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করছে। শুধু তাই নয়, তিনি বিরোধীদের বিরুদ্ধে এই কথিত আমেরিকান ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনেন, এমনকি তাদের বিশ্বাসঘাতকও বলেন।

অনাস্থা প্রস্তাব বানচালের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতে, যুক্তরাষ্ট্র যে বার্তা দিয়েছিল তার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। তবে এর পুরোটাই ছিল ভিত্তিহীন। কেননা বার্তাটি মার্কিন এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার পর ওয়াশিংটন ডিসি থেকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের পাঠানো একটি বার্তা ছিল। এদিকে গণমাধ্যমগুলোতেও প্রচারিত হতে থাকে যে, সেনাবাহিনী কোনো ষড়যন্ত্র করার কথা অস্বীকার করেছে।

পাকিস্তান বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এ ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে বেশ মাতামাতি করে থাকে। ইমরান ভেবেছিলেন এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পর তার পক্ষে জনসমর্থন বাড়বে। চাপা পড়বে তার যাবতীয় ব্যর্থতা। ইমরানের এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরি হবে যেন তিনি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য লড়াই করে চলেছেন। সর্বোপরি একজন জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমী হিসেবে তিনি পরবর্তী নির্বাচনে দাঁড়াবেন।

এদিকে পার্লামেন্টে পরিকল্পিতভাবে ডেপুটি স্পিকার কোনো প্রমাণ বা বিতর্ক ছাড়াই অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করেন এবং সমাবেশ স্থগিত করা হয়। অন্যদিকে, ইমরান খান রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন এবং রাষ্ট্রপতি তা করতে বাধ্য হন।

ইমরান দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করার আহ্বান জানান। অনাস্থা প্রস্তাবের ফলাফল মানবেন না বলেও ঘোষণা দেন তিনি। গণতান্ত্রিকভাবে মাথানত না করে, তিনি পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই গুটিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন।

ইমরান আশা করেছিলেন, বিচারব্যবস্থা তাকে সমর্থন দিবে। বরাবরের মতো, বিভিন্ন অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানানোর মতোই তার পদক্ষেপকেও ‘রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত’ হিসেবে ঘোষণা করবে। ফলে তিনিও সংবিধান লঙ্ঘনের মতো গুরুতর দায় থেকে অব্যাহতি পাবেন।

তবে সুপ্রিম কোর্ট আশ্চর্যজনকভাবেই ডেপুটি স্পিকারের পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক ঘোষণার পাশাপাশি জাতীয় পরিষদ (পার্লামেন্ট) পুনর্বহাল করে। ৯ এপ্রিল অনাস্থা ভোট গ্রহণের দিন পুনর্নিধারণ করে সুপ্রিম কোর্ট। ইমরান বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে ভোট বানচালের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায় যে, তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়াকে উৎখাত করে ফয়েজ হামিদকে নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমলাতন্ত্রের সমর্থন না পাওয়ায় তা কার্যকর হয়নি।

ইসলামাবাদের বাতাসে যেসব ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে, সেগুলো বিশ্বাস করলে বলতে হবে- ইমরান খানকে কিছুটা নাস্তানাবুদ করতেই সেনাবাহিনী এ ধরনের অবস্থান নিয়েছে। ইমরান শেষ মুহূর্তে কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারেন, এমন আশঙ্কা থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাতের বেলাও আদালত খোলা ছিল। শেষপর্যন্ত অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয় এবং বিরোধীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। ফলশ্রুতিতে সম্ভবত প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে গণতান্ত্রিকভাবে বিদায় নিতে হলো।

– তিলক দেবশ্বর, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য।

অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে টিবিএস-এর সৌজন্যে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।