Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বেফাঁস কথার গেরো থেকে সাবধান

বেফাঁস কথার গেরো থেকে সাবধান

।। মুফতি এনায়েতুল্লাহ ।।

সাম্প্রতিক সময়ে কটূক্তি ও বেফাঁস কথার গেরোয় ফেঁসে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন আলোচিত ও প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি পদ হারিয়ে ব্যাপকভাবে নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছেন। বেফাঁস মন্তব্য, অশালীন উক্তি, গালি-গালাজ, বেশি কথা বলা কিংবা অতিকথন একটি রোগের মতো। ভারতীয় উপমহাদেশে এমন রোগের দেখা প্রায়ই মেলে। সাহিত্যে অতিকথন অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে অতিকথন রাজনীতিতে দৃশ্যত চমক সৃষ্টি করলেও আখেরে এর পরিণতি হয় খুবই খারাপ। অতিকথনের বদভ্যাস পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নানা ঝুটঝামেলা সৃষ্টি করে। কোনো কোনো সময় তা ডেকে আনে মারাত্মক বিপর্যয় ও সামাজিক লাঞ্ছনা। এ জন্য অভিজ্ঞজনরা অতিকথন পরিহারের পরামর্শ দেন, অভিজ্ঞতার আলোকে।

এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই এবং বাস্তবতা হলো, বেশি কথা বললে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি। তারপরও আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্রায়ই অপ্রয়োজনীয়, বেফাঁস, কটূক্তি ও বাজে কথা বলতে শোনা যায়, যা জনমনে বিভ্রান্তি, ক্ষোভ, বিস্ময় সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে তাতে বক্তার জ্ঞান-গরিমা ও নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সমাজের সামনে লজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি হতে হয় ধর্মের চোখে অপরাধী। অতিকথনের কুফল সম্পর্কে কমবেশি প্রায় সবার জানা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই অনবরত এর চর্চা করেন। প্রবাদে আছে, ‘বেশি কথায় ক্ষ্যাতা (কাঁথা) হারানো যায়’। অর্থাৎ- বেশি কথা বললে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে বেশি।

দেশের মানুষ সাধারণত রাজনীতিকদের সম্পর্কে উঁচু ধারণা পোষণ করেন। ফলে তাদের কাজকর্ম, কথাবার্তা হবে অবিতর্কিত ও গ্রহণীয়। কিন্তু যখন দেখা যায়, একজন নেতা এমনসব কথা বলছেন, যা কোনো বিচারেই যুক্তিযুক্ত নয়। তারপরও তারা প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে এমনসব কথা বলেন, যা শুনলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, তারা আগপাছ চিন্তা না করে এমন কথা বলেন, যার মর্মার্থ বুমেরাং হয়ে তার বা তাদের ওপর গিয়েই পড়ে। বেফাঁস কথার ফাঁসে ইতিপূর্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ফেঁসেছেন, এর ফিরিস্তিও বেশ লম্বা। বেফাঁস মন্তব্যকারীদের কেউ আর সেভাবে মূলধারার রাজনীতিতে টিকতে পারেননি, ছিটকে গেছেন; ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঘৃণিতভাবে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।

আরও পড়তে পারেন-

অনেক দিন আগে এক লেখায় মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপযোগিতার সুন্দর একটি ব্যাখ্যা পড়েছিলাম। ওই লেখায় মানুষের দু’কান, দু’চোখ, দু’হাত, দু’পা, এক নাক, এক মুখ, সামনের দিকে তাকানো, সামনের দিকে হাঁটা- এসব নিয়ে খুব সুন্দর ব্যাখ্যা ছিল। ওই ব্যাখ্যার বৈজ্ঞানিক কিংবা আধ্যাত্মিক কোনো ভিত্তি আছে কিনা জানি না, দীর্ঘদিন পর আজ নাম মনে না থাকা লেখকের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। তিনি দু’কান আর এক মুখ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, দু’কান থাকার অর্থ ভালো করে শোনা। আর এক মুখে যত কম বলা যায়। অর্থাৎ শোনো বেশি, বলো কম। দু’চোখে আমরা সামনের সবকিছু সুন্দরভাবে দেখি। চলার সময় দু’হাত সামনের দিকে ধাবমান থাকে। পা’দুটোও সামনের দিকে হাঁটে। অর্থাৎ সামনে তাকাও, দু’হাত দু’পা ব্যবহার করে সামনে বাড়ো।

বাংলাদেশে এখন অনেক টিভি চ্যানেল, অনেক পত্রিকা, অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকে ভরা। এদেশে অনেক রাজনৈতিক দল, অনেক সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠন। রয়েছে আবার ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনও। অনেক শ্রেণি-পেশার সংগঠনও দেশজুড়ে গিজগিজ করছে। এগুলোতে নেতা-কর্মীর সংখ্যা কম নয়। এসব নেতা-কর্মী নানা কারণে অনেক কথা বলেন। আবার সাংবাদিকরাও তাদের কাছ থেকে কথা আদায়ের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। এসব অবশ্য আলোচ্য বিষয় নয়। কেউ বাকচর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেই পারেন। কিন্তু কথা হলো, যারা নেতৃত্ব পর্যায়ে আছেন, হোক তা প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠন অথবা দেশের; তারা যদি অতিকথন চর্চা না করতেন তাহলে বোধকরি আমরা আরও আগেই কর্মে-যোগ্যতায় অনেক দেশকে টপকে যেতে পারতাম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মুখের রাশ টানা বোধহয় সত্যিই কষ্টকর। তা না হলে অতিকথনের বিপর্যয় থেকে আমরা এখনও কেন শিক্ষা নিচ্ছি না। চোখের সামনে তাজা তাজা উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও উট পাখির মতো মুখ বুজে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

শুধু শাসক দল নয়, দেশের একাধিক বড় রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানা মন্তব্য করেন, যেগুলো শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও যথেষ্ট। জ্যেষ্ঠ নেতাদের এসব কথা অনেক সময় কনিষ্ঠদের উদ্দীপ্ত করে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন কথা বলা, অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। অনেক সময় এটা বলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বড়রা বললে ছোট নেতারা তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এসব প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত না করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ধর্মকে বাদ দিয়ে, ধর্মীয় বিষয়ে কটূক্তি করে, আশালীন কোনো মন্তব্য করে, বেফাঁস কথা বলে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর যাই হোক রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না, এটা প্রমাণিত সত্য। সুতরাং মুখের কথা বিপদের কারণ হতে পারে, এ বিষয়টি মাথায় রেখে রাজনীতিবিদসহ সর্বস্তরের মানুষের কথা বলা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার এবং এটা সময়ে দাবি।

লেখক: আলেম, সাংবাদিক।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।