Home শিক্ষা ও সাহিত্য মাগুরার এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী যেভাবে পোল্যান্ডে কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন

মাগুরার এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী যেভাবে পোল্যান্ডে কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন

মিরাজ হোসেন: মধ্য ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডের একটি শহর রোচওয়াভ (Wroclaw)। শহরটির ব্রিটিশ গ্র্যাজুয়েট কলেজ-এর ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানের পর একদল শিক্ষার্থী খাবার খেতে পার্শ্ববর্তী একটি রেস্তোঁরায় গেলেন। সেখানে গিয়ে তাদের চক্ষু চড়কগাছ! খাবার পরিবেশনকারী ওয়েটার দেখতে হুবহু তাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকের মতো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে জানা গেল ওয়েটারটি আসলেও ছিলেন তাদের কলেজের পরিচালক হোসেন আলম।

মাগুরা জেলায় বেড়ে ওঠা আলম একজন বাংলাদেশি প্রবাসী। ২০১১ সালে স্নাতকের ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা করতে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান তিনি। পরের ১০ বছরে স্নাতকের পর একই দেশে স্নাতকোত্তর শেষ করে পিএইচডি পড়ার পাশাপাশি পোল্যান্ডে একটি উচ্চশিক্ষা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন আলম।

পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব রোচওয়াভ-এর ইন্সটিটিউট অব পলিটিক্যাল সায়েন্স-এ তার পিএইচডি থিসিসের সুবিধার্থে আলম যুক্তরাজ্যের দুটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিন্ন দুটো ডিগ্রি নেন; ইউনিভার্সিটি অভ সান্ডাররল্যান্ড থেকে বি. এ. (সম্মান) এবং ইউনিভার্সিটি অভ ক্যান্টারবারি ক্রাইস্টচার্চ থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিষয়ে এম.এসসি ডিগ্রি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তার পিএইচডির বিষয় ‘সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামাজিক ব্যবসায় মডেল-এর অবদান।’

এর আগে তিনি ইউনিভার্সিটি অব লজিস্টিকস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট-এ প্রভাষক হিসেবে পাঠদান এবং ইউনিভার্সিটি অব রোচওয়াভ-এ শিক্ষা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন।

তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনফারেন্সগুলোর একটি ইউরোপিয়ান কনসোর্টিয়াম ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ (ইসিপিআর)-এ তার গবেষণাপত্রটি চারবার উপস্থাপন করেছিলেন। ২০২০ সালে ইসিপিআর-এর রাইজিং স্টার অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এছাড়াও ইন্সব্রাক ইউনিভার্সিটিতে এ বছরে অনুষ্ঠিত ইসিপিআর কনফারেন্সে একজন প্যানেল চেয়ার ছিলেন।

শুরুর দিকের সংগ্রাম

তার এই অসাধারণ অর্জনগুলো আরও বেশি বিস্ময়কর কারণ তিনি কোনো সুবিধাভোগী অবস্থান থেকে উঠে আসেননি। হোসেন আলম সম্পূর্ণ সচেষ্টায় নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। একেবারে ‘সেলফ-মেইড ম্যান’ যাকে বলে।

জন্মস্থান ঘুল্লিয়া (মাগুরার একটি দরিদ্র গ্রাম যেখানে সাক্ষরতার হার মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ) থেকে ইউনিভার্সিটি অব রোচওয়াভ, যে বিশ্ববিদ্যালয় তার ৩০০ বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসে নয়জন নোবেলজয়ী তৈরি করেছে—হোসেন আলমের সফলতার যাত্রাটি সুদীর্ঘ। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে জুমে অনলাইন সাক্ষাৎকারে তার সংগ্রাম এবং সফলতার গাথা শোনালেন আলম।

‘ছোটবেলায় আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত, সবচেয়ে কাছের স্কুলটিও ছিল আমার গ্রাম থেকে আট কিলোমিটার দূরে,’ কথাগুলো বলছিলেন আলম। উপায় না পেয়ে তিনি বাড়ির কাছাকাছি ঘুল্লিয়া দাখিল মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে ২০০৫ সালে দাখিল শেষ করেন। প্রায় সব শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করা দেখেই বোঝা যায় ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এরপর মাগুরা সিদ্দিকা কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাসের পর তিনি রাজধানী ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. এড. (সম্মান) সম্পন্ন করেন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেশনজট নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। জানান, ‘রাজনৈতিক লবিং ছাড়া ভালো চাকরি পাওয়া খুব কঠিন ছিল।’ তাই একসময় বিদেশে পড়ার চিন্তা করতে থাকেন আলম।

আরও পড়তে পারেন-

যুক্তরাজ্যের ক্যান্টারবারির ওয়ার্নবার্গ কলেজে সুযোগ পেলে টিউশনের বেতন থেকে সঞ্চিত টাকার পুরোটা এবং পরিবার থেকে কিছু সাহায্য নিয়ে পড়তে যান তিনি। ঢাকায় থাকাকালে নিজের আয় দিয়ে কিছু শেয়ার কিনেছিলেন যার সাহায্যে বেতন পরিশোধ করতেন।

২০১১ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানোর পর সেখানে চারজন রুমমেটের সাথে ২৫০ ইউরো দিয়ে একটি কক্ষে ভাড়া থাকতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি রেস্তোঁরায় কিচেন পোর্টারের কাজ নেন তিনি। কিন্তু সেটি ব্যস্ত রেস্তোঁরা হওয়ার কারণে তাকে অনেকক্ষণ ধরে কাজ করতে হতো। লাগাতার থালাবাসন ধোঁয়া, মেঝে পরিষ্কার করে রাখার কাজ পড়াশোনা অসম্ভব করে তুলছিল। তাই কয়েক মাস পর একই রেস্তোঁরায় তিনি ওয়েটার হিসেবে কাজ শুরু করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক কৃতিত্ব

ওয়ার্নবার্গ কলেজে এক বছর পড়াশোনার পর ইউনিভার্সিটি অভ সান্ডারল্যন্ড-এ যান ব্যাচেলর ডিগ্রি নিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি এবং বাসাভাড়া মেটাতে একসাথে তিনটি চাকরি নেন তিনি। সকালে দুই ঘণ্টার পরিচ্ছন্নকারীর চাকরি, কেন্ট ইউনিভার্সিটির হসপিটালিটি এসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি এবং সন্ধ্যায় একটি রেস্তোঁরায় ব্যবস্থাপনার কাজ করতে হতো তাকে। এগুলোর পাশাপাশি মাঝেমধ্যে ড্রাইভিং শেখা ও ডেলিভারির কাজ করতেন তিনি।

এত কাজের ভিড়ে ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত সময়টুকুও পেতেন না হোসেন। ‘ক্যান্টারবারি থেকে সান্ডারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াতের সময় ট্রেনে ঘুমাতাম’, জানালেন এই অদম্য জীবনযোদ্ধা।

স্নাতকোত্তর শেষে পিএইচডির জন্য আবেদন করেন। যুক্তরাজ্যের দুটো বিশ্ববিদ্যালয় তার গবেষণা প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু স্কলারশিপ না পাওয়ায় সেখানে পিএইচডি করা হলে ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি। পরবর্তীতে ফ্রান্স, স্পেন এবং পোল্যান্ডের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় তার গবেষণা প্রস্তাব গ্রহণ করে। অবশেষে তিনি ২০১৭ সালে পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অভ রোচওয়াভ-এ পড়তে যান।

মাত্র চার মাস ১৫ দিনে আলম তার পিএইচডি প্রসিডিউর শেষ করেন যা ভীষণ কঠিন একটি কাজ; তাছাড়া একাধিক জার্নাল প্রকাশনার প্রয়োজন হয়। নামকরা জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে গবেষণা উপস্থাপনার জন্য পরপর দুইবার বেস্ট স্টুডেন্ট রেক্টর স্কলারশিপ পান তিনি।

সফলতার গাঁথা এখানেই শেষ নয়। এখন পর্যন্ত তিনি মোট সাতটি আর্টিকেল প্রকাশের পাশাপাশি ৩০টির অধিক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে গবেষণাপত্র উপস্থাপনা করেছেন। সম্প্রতি একটি বইয়ে তার লেখা দুটি অধ্যায় প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক অ্যাকাডেমিক প্রকাশক আইজিআই গ্লোবাল পাবলিশার। অধ্যায় দুটির শিরোনাম হলো ‘রোল ইন টেকনোলজি ইন ফরমাল এডুকেশন ইন বাংলাদেশ’ এবং ‘রোল অব ইকোনোমিকস অ্যান্ড দ্য কনট্রিবিউশন অব গ্রামীণ ব্যাংক।’

ব্রিটিশ গ্র্যাজুয়েট কলেজ প্রতিষ্ঠা

অসাধারণ অ্যাকাডেমিক সফলতার পরেও তিনি যেন পরিতৃপ্ত নন। আরও বড় কিছু করতে চেয়েছিলেন আলম। যার ফলে একসময় তিনি পোল্যান্ডের রোচওয়াভ শহরে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ গ্র্যাজুয়েট কলেজ।

এর পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি জানান, ‘আমি উপলব্ধি করলাম সমাজে আমার অবদান কেবল সাধারণ চাকরিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু আমি এমন কিছু করতে চেয়েছিলাম যেটি আরও বড় পরিসরে অবদান রাখবে এবং যেটি করে আমার মৃত্যুর পরও উত্তরাধিকার থেকে যাবে।’

তিনি তার কলেজের অধীনে একটি প্রোগ্রামের ঘোষণা করেন যার মাধ্যমে বাংলাদেশের দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ দেওয়া হবে।

‘আমি একজন পিএইচডি, একজন কলেজ পরিচালক এবং রেস্তোঁরার ওয়েটার। এই তিন জায়গায় আমার ভিন্ন ভিন্ন তিন ভূমিকা রয়েছে এবং আমি সেভাবেই তা পালন করি’, বিনয়ের সাথে বললেন হোসেন আলম।

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।