Home ওপিনিয়ন পোলট্রি খাত সমস্যার অন্তরালে সিন্ডিকেট

পোলট্রি খাত সমস্যার অন্তরালে সিন্ডিকেট

এ এইচ খান রতন

দেশে সিন্ডিকেট বাণিজ্যের গোড়াপত্তন, সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে, স্বাধীনতার ঠিক পরপর। সদ্য ভ‚মিষ্ঠ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির নিম্নমধ্যবিত্ত অভাবী মানুষ, দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত, তখন লবণসিদ্ধ খাবারে ক্ষুধা নিবারণে চেষ্টা করছিল। এই অসাধু চক্রটি তখন, লবণের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে, ৮০ পয়সার সোয়াসের লবণের মূল্য, এক লাফে ৩২ টাকা সের দরে আদায় করে নিয়েছিল। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে হতদরিদ্র মানুষের ওপর, সিন্ডিকেট সন্ত্রাসের প্রথম মহড়া। তখন এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়ায়, সিন্ডিকেট সন্ত্রাসীদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

ব্যাংক-বীমা, শেয়ারবাজার, চাল, ডাল, তেল, চিনি, পরিবহন সেক্টর, সব জায়গায় এখন সিন্ডিকেট। দেশবাসী জানে, ডজন খানেক গোয়েন্দা বিভাগ, তাদের করের টাকায়, অতন্দ্র প্রহরীর মতো জনগণের সেবায় নিয়োজিত। এ বিষয়ক তাদের সফলতা খুব নগণ্য। ব্যবস্থা নেয়ার আগেই আগাম তথ্য পৌঁছে যায় সিন্ডিকেট দফতরে, আর সিন্ডিকেট সফলতার সাথে লক্ষ্যসাধন করে, নিরাপদে সরে পড়ে। সরকার নীরব, আর জনগণ অন্ধকারে। রাজনৈতিক বক্তব্যে ভিন্নতা থাকলেও পর্দার অন্তরালে জনগণকে শোষণের ক্ষেত্রে তারা এক ও অভিন্ন। কারণ তাদের সন্তানদের শিক্ষা ও বসবাস ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশে, আর ওই সব দেশে বিলাসবহুল জীবনযাপনের ব্যয়ভার সরবরাহ হয়ে থাকে দুর্নীতি করে এ দেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ পাচারের মাধ্যমে। দুর্নীতি আর বাংলাদেশ যেন সমার্থক হয়ে গেছে। সিন্ডিকেট বাণিজ্যের বিধ্বংসী থাবায় সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ; চিরকাল যারা দেশকে দিয়ে গেছে বেশি-নিয়েছে কম। দেশের অর্থনীতির শিরা-উপশিরায় যাদের ঘাম জড়ানো বিশুদ্ধ রক্ত টনিকের মতো প্রবহমান। কিন্তু শোষিত এ শ্রেণীর না আছে অভিযোগের স্থান, না আছে প্রতিবাদের ভাষা, না আছে সমস্যার সমাধান।

পোলট্রি খামারিদের অবস্থা লক্ষ করলে সহজেই বোঝা যায়, সিন্ডিকেট হায়েনার বিধ্বংসী থাবা কতটা ভয়ঙ্কর। কোনো প্যাথলজিক্যাল টেস্ট কিংবা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই, খামারিদের অসহায় চোখমুখই তা বলে দেয়। ক্রমান্বয়ে দেশের এক লাখ ৯০ হাজার পোলট্রি খামার কমে এখন এক লাখের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে; আর ৯০ টাকা ডজনের ডিম মানুষ ১৬০ টাকায় ক্রয় করতে বাধ্য হয়েছে। বাজারে শীতের সবজি সরবরাহে যদিও ডিম ও মুরগির দাম কমতে শুরু করেছে, তা ভোক্তা সাধারণের জন্য সুখবর হলেও খামারিদের জন্য আরেক দুঃসংবাদ। কারণ ফিড সিন্ডিকেট সম্প্রতি ফিডের মূল্য ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত পোলট্রি পণ্যের মূল্যে হ্রাস-বৃদ্ধি কোনোটার সুফলই খামারিদের ভাগ্যে জোটে না।

আরও পড়তে পারেন-

পোলট্রি সেক্টর ঘিরে সিন্ডিকেটের সংখ্যা কম করে হলেও সাতটি। ১. পুলেট সিন্ডিকেট; ২. ফিড সিন্ডিকেট; ৩. ডিম সিন্ডিকেট; ৪. ওষুধ সিন্ডিকেট; ৫. ভুয়া ওষুধ সিন্ডিকেট; ৬. চিকিৎসক সিন্ডিকেট ও ৭. হাতুড়ে চিকিৎসক সিন্ডিকেট। এই সাতটি সিন্ডিকেটের সাথে মধ্যস্বত্বভোগী বিশাল এক দালাল সিন্ডিকেট জড়িত, যে চক্রটি লেখাপড়া না জানা বেশির ভাগ সাধারণ খামারির রক্তচুষে নিজেরাও খাচ্ছে, উপরের সাত সিন্ডিকেটকেও খাওয়াচ্ছে। এ ছাড়া খামারিদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে বছরব্যাপী প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ধারাবাহিক বরাদ্দ সিন্ডিকেট তো আছেই। বেশির ভাগ বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফিড উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকায় তাদের অভ্যন্তরীণ কারসাজির ভুক্তভোগী কখনো খামারি আবার কখনো ভোক্তা সাধারণ। পোলট্রি ফিড উৎপাদনের প্রধান উপাদান ৬০ শতাংশ ভুট্টা, যার বর্তমান বাজার দর ৩৬ থেকে ৩৮ টাকার বেশি নয়। অথচ লেয়ার ও ব্রয়লার ফিড যথাক্রমে ৫৯ ও ৭০ টাকা কেজিতে ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন খামারিরা। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এক হাজার ৮০০ টাকার পোলট্রি ফিডের দাম বেড়ে এই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দ্রুততম সময়ে এই সিন্ডিকেট ভাঙার ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে পোলট্রি খাত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতের সাথে জড়িয়ে আছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ লোকের জীবিকা। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনায় অদক্ষতা, লাগামহীন দুর্নীতি আর পোলট্রি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যর্থতাই মূলত এর জন্য দায়ী।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের আচরণেই স্পষ্ট, তারা সমস্যার গভীরে পৌঁছাতে পারেননি বা সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানকল্পে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছেন না। টকশো বিতর্কে বাগ্মিতার পারদর্শিতায় রাজনীতির লাইমলাইটে দলীয় প্রধানের দৃষ্টিতে পড়ে রাজনৈতিক পদ-পদবি, এমপি, মন্ত্রী হওয়া যেতে পারে, আদালতের এজলাসে আইনের মারপ্যাঁচে তর্কবাগিশী করে পাণ্ডিত্য জাহির করা যেতে পারে। কিন্তু এক হাজার ৪০০ টাকার ফিড খেয়ে এক ডিম পাড়া মুরগি তিন হাজার টাকার ফিড খেয়ে দুই ডিম না দিলেও আইন কিংবা তর্কের চাপে মুরগিকে দুই ডিম পাড়তে বাধ্য করা সম্ভব নয়। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রয়োজন বাস্তবতার আলোকে সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

দায়িত্ব পাওয়া নিজ মন্ত্রণালয়ে হাজারো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে দেশ উদ্ধারে অনাকাক্সিক্ষত কর্মব্যস্ততা, বক্তব্য-বিবৃতি ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, পোলট্রি সেক্টরের প্রতি অবহেলা এ সেক্টরকে খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়েছে। সেক্টরটি এখন পাহাড়সম সমস্যায় জর্জড়িত এবং জাতির ওপর লুটপাটের এক কৌশলী দফতরের প্রতিচ্ছবি। জনগণের করের শত শত কোটি টাকা পোলট্রি সেক্টর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লোপাট নিয়মিত ব্যাপার। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে- এভিয়ান ইনফ্লুয়েনজা প্রতিরোধে ১৩৭ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। খামার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত যেখানে নিরাপদ পানি ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশ, যা সরকারি উদ্যোগে খামারিদের জন্য বাধ্যতামূলক শর্ত হওয়া উচিত, সেখানে খামারিদের প্রশিক্ষিত করার জন্য চোখেপড়ার মতো কোনো কর্মসূচি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাধ্যতামূলক কর্মসূচিতে নেই; অথচ এটি অপরিহার্য। তা হলে যেখানে ন্যূনতম প্রাথমিক পাঠ বাস্তবায়নের ব্যবস্থাই নেই, সেখানে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দের কী উদ্দেশ্য তা বোধগম্য নয়।

পোলট্রি সেক্টর চলছে তিন যুগ আগের প্রচলিত পুরনো ধাঁচে। যুগোপযোগী কোনো পরিকল্পনা নেই। যার ওপর ভিত্তি করে শত শত ভুয়া ভেটেরিনারি ওষুধ কোম্পানি গড়ে উঠেছে, যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওষুধের আদৌ কোনো মান ও বৈধতা বলে কিছু নেই। মিটফোর্ডের খোলাবাজারে শাকসবজির মতো কেমিক্যাল ক্রয় করে, বিদেশী নামীদামি ব্র্যান্ডের চটকদার প্যাকেটজাত করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভুয়া কোম্পানিগুলো। যাদের বিচারের আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ কারো নেই। অবৈধ এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সহযোগী, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারী। মাসের শুরুতেই তারা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে দালালদের মাধ্যমে বিক্রি হয়ে যায় এবং নীতি ও নৈতিকতা হারিয়ে, কার্যকরী ওষুধ নয় জেনেও ভুয়া কোম্পানির যোগসাজশে মাসব্যাপী খামারিদের হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিতে থাকেন। কাজেই বিক্রি করে দেয়া নৈতিকতা স্বাভাবিকভাবেই অকার্যকর থাকে এবং যেগুলো বাস্তবে ওষুধই নয় জেনেও তিনি লিখে থাকেন। খোলাবাজারের এই এন্টিবায়োটিক মুরগির দেহে প্রবেশের ফলে মুরগি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন হয়ে পরবর্তীতে প্রকৃত ওষুধও মুরগির দেহে অকার্যকর হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ প্রাণিসম্পদ অফিসে গোপন অনুসন্ধান চলালেই তা বেরিয়ে আসবে। উপজেলা পর্যায়ের অসৎ প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা অবৈধ এই কর্মে মাসিক বেতনের কয়েকগুণ পর্যন্ত আয় করে থাকে। দামি মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, ল্যাপটপ, সন্তানদের বিয়ের খরচ, এমনকি গাড়ি উপহারের প্রমাণও তদন্তে মিলবে। কাজেই, যিনি রক্ষক তিনিই যদি ভক্ষক, তো প্রকৃত অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। অথচ যে কয়েকটি রোগের ওপর ভিত্তি করে ভুয়া ওষুধ বাণিজ্য চলছে এবং খামারিরা সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছেন তার ৮০ শতাংশ নিরাময়যোগ্য, শুধু পানি ও পরিবেশের ওপর সচেতনামূলক প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে। প্রতি জেলায় জেলায় প্রশিক্ষিত টিম গঠন করে ভ্রাম্যমাণ কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূল খামারিদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে।

প্রাণিসম্পদ সেক্টর উন্নয়নে প্রতিযোগিতামূলক উদ্ভাবনী কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে, যেখানে অর্থ খরচ করলে এ সেক্টরকে রোগ ও ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজ্ঞানের ছাত্রদের ১৩২ বছর আগের ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত¡ পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে, পৃথিবী যা আগেই পরিত্যাগ করেছে। পোলট্রি সেক্টর রক্ষায় আমাদের উচিত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নেয়া, যেখান থেকে আমরা পিছিয়ে আছি বহুদূর।

ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের পোলট্রি সেক্টর সরকার কিংবা বড় কোনো শিল্প উদ্যোক্তার আশীর্বাদের ফসল নয়। প্রায় তিন যুগ আগে নিতান্ত পারিবারিক বেকারত্ব ঘোচাতে প্রান্তিক পর্যায়ের মহিলাদের হাতে ১০-২০টি মুরগির বাচ্চা প্রতিপালনের মাধ্যমেই এ সেক্টরের ভিত্তি সূচিত হয়, যা আজ জিডিপির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাদের উচিত এ সেক্টর রক্ষায় সর্বাত্মক মনোযোগী হওয়া। পত্রিকার পাতাগুলো ও বিভিন্ন মিডিয়া পার্শ্ববর্তী দেশের অখ্যাত নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে ব্যস্ত, লেখালেখি ও কালি-কাগজ খরচ করছে, দেশের পোলট্রি খাত রক্ষায় তার সামান্য অংশও যদি তুলে ধরত, সরকার বাধ্য হতো এ সেক্টর রক্ষায় সমস্যা খুঁজে বের করে সংস্কারে হাত দিতে। দুর্বল ভিত্তির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণ যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, পোলট্রি সেক্টরের ন্যূনতম নীতিমালা ঠিক না করে এ খাতে জনগণের করের টাকা ব্যয় করা তেমনি হতবুদ্ধিতা।

একটা সময় ছিল দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ বছরে ১০-১৫টি ডিম ও পাঁচটি মুরগি খাওয়ার কথা ভাবতেও পারত না। গরুর গোশত খাওয়া তো বিশেষ কোনো পার্বণ ছাড়া চিন্তাও করত না। আজ তারাই এসব পণ্যের উৎপাদক হওয়ায় নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে বিত্তশালী, সবার জন্য ডিম ও প্রাণিজ আমিষ প্রাপ্তির সহজলভ্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে পোলট্রি খাত। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার কাছে পণ্য দু’টির চাহিদাও শীর্ষে। কাজেই সরকারি দফতরগুলোর দায়িত্ব, বিশৃঙ্খল এই সেক্টরে দ্রæততম সময়ের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে খামারভিত্তিক অর্থনীতিকে সচল করা। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের সরকারের কাছে এ মুহূর্তে এমনটিই প্রত্যাশা।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।