।। হামিদ মীর ।।
কখনো কল্পনাও করিনি, পিতার পর পুত্রের শাহাদতের ওপর শোক প্রকাশ করে কলাম লিখতে হবে। ২০১৮ সালে মাওলানা সামিউল হককে শহীদ করা হলে তার পুত্র হামিদুল হক ও রাশিদুল হক হাক্কানিকে সমবেদনা জানিয়েছিলাম। ২০২৫ সালে হামিদুল হক হাক্কানিকে মসজিদে শহীদ করা হলে তার পুত্র আবদুল হক হাক্কানিকে সমবেদনা জানানো বেশ কঠিন মনে হচ্ছিল।
মাওলানা হামিদুল হক হাক্কানির শাহাদতের যোগসূত্র সেই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত, যার অধীনে কখনো আল্লামা ইহসান ইলাহি জহিরকে লাহোরে বোমা হামলার লক্ষ্য বানানো হয়। সেই সাথে তার শাহাদতের পরপর তৎক্ষণাৎ পেশোয়ারে আল্লামা আরিফ হুসাইন আল হুসাইনিকে শহীদ করে দেয়া হয়। যাতে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে একে অপরের সাথে লড়াই বাধিয়ে দেয়া যায়।
শহীদ মাওলানা সামিউল হককে ওই সব আলেমের মধ্যে গণ্য করা হয়, যারা সর্বদা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আফসোস, তার কর্মের এ ইতিবাচক দিকটি জাতীয় গণমাধ্যমে বেশি তুলে ধরা হয়নি। ১৯৯৬ সালে একটি উর্দু পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আমি নামসর্বস্ব সিপাহ সাহাবা ও নামসর্বস্ব সিপাহ মুহাম্মাদের মধ্যে আমার পত্রিকার পাতায় আলোচনা শুরু করার চেষ্টা করলে, মাওলানা সামিউল হক আমাকে বেশ সাহস জুগিয়েছিলেন। আল্লামা জিয়াউর রহমান ফারুকি ও আল্লামা মুরিদ আব্বাস ইয়াজদানির মাধ্যমে আলোচনার সূচনা হয়। ইয়াজদানিকে ওই বছর ইসলামাবাদে শহীদ করে দেয়া হয়। আর আল্লামা জিয়াউর রহমান ফারুকিকে ১৯৯৭ সালে লাহোরের সেশন কোর্টে বোমা হামলার লক্ষ্য বানানো হয়। এটি সেই সময়ের কথা, যখন মাওলানা সামিউল হক, মাওলানা শাহ আহমদ নূরানি, আল্লামা সাজিদ নাকবি, আল্লামা সাজিদ মীর, কাজি হোসাইন আহমদ, মাওলানা আজমাল খানসহ আরো উলামায়ে কেরাম মিল্লি একজেহাতি কাউন্সিলের ব্যানারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নে কার্যকর প্রচেষ্টার সূচনা করেছিলেন।
মিল্লি একজেহাতি কাউন্সিল পরবর্তীতে মুত্তাহেদা মজলিসে আমলকে জন্ম দেয় এবং ২০০২ সালে হামিদুল হক হাক্কানি মুত্তাহেদা মজলিসে আমালের (এমএমএ) টিকিটে জাতীয় অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। হামিদুল হক হাক্কানি পিপলস পার্টির মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত নাসিরুল্লাহ বাবরকে পরাজিত করেছিলেন। বিস্ময়ের কথা হচ্ছে, নাসিরুল্লাহ বাবর ও মাওলানা সামিউল হক উভয়ের আফগান তালেবানের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল। তালেবান নেতাদের সাথে আমার পরিচয় ঘটে নাসিরুল্লাহ বাবরের মাধ্যমে। পরবর্তীতে আকোড়া খটকের দারুল উলুম হাক্কানিয়ার সমাবেশে আরো অনেক তালেবান নেতার সাথে সাক্ষাৎ হয়। এটি সেই মাদরাসা, যা মাওলানা সামিউল হকের পিতা মাওলানা আবদুল হক পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষক ছিলেন। তার মাদরাসা থেকে জালালুদ্দিন হাক্কানিসহ বুরহানুদ্দিন রব্বানি, মৌলভি নবী মোহাম্মদি, মৌলভি ইউনুস খালেস ও অপর আফগান নেতারাও শিক্ষা অর্জন করেন। মাওলানা ফজলুর রহমানও এ মাদরাসার ছাত্র ছিলেন।
যখন মিল্লি একজেহাতি কাউন্সিল গঠন করা হলো, তখন মাওলানা সামিউল হক মিল্লাতে জাফরিয়ার নেতা আল্লামা সাজিদ নাকবিকে আকোড়া খটকের দারুল উলুম হাক্কানিয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজেদের শত্রুদের আগুনে ছুড়ে মারেন। হামিদুল হক হাক্কানিও তার শহীদ পিতার মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে পাকিস্তান রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু মনে করেন। ২০০২ সালে তিনি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য হলে আমি প্রায়ই তাকে পার্লামেন্ট হাউজের লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারতে দেখেছি। তার দাদা মাওলানা আবদুল হক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আজমল খটককে পরাজিত করে জাতীয় অ্যাসেম্বলির সদস্য হয়েছিলেন। মাওলানা আবদুল হক ১৯৭৩ সালের সংবিধান প্রণয়নে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একবার হামিদুল হক হাক্কানি আমাকে কিছু রেকর্ড দেখিয়ে বললেন, মুফতি তকি উসমানী ও মাওলানা সামিউল হক উভয়ে মিলে ১৯৭৩ সালের প্রস্তাবিত সংবিধানের খসড়া পড়েন এবং মাওলানা সামিউল হককে ওই খসড়ায় সংশোধনীর জন্য দুই শতাধিক প্রস্তাব দেন।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
হামিদুল হক হাক্কানি ও তার ভাই রাশিদুল হক হাক্কানি এ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন, তাদের পিতা মাওলানা সামিউল হকের শাহাদতের পর তার সাথে সংশ্লিষ্ট দস্তাবেজগুলো গ্রন্থাকারে রূপ দেন। তাতে মাওলানা সামিউল হকের নামে লেখা মাওলানা আবুল আলা মওদূদী, মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহি, ড. হামিদুল্লাহ, মাওলানা সরফরাজ খান সফদার, মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান, মুফতি নিজামুদ্দীন শামযায়ি, মুফতি তকি উসমানী, মুফতি রফি উসমানী, মাওলানা যাহেদ আর-রাশেদি, মাওলানা হামিদ মিয়া, মাওলানা মুহাম্মদ হানিফ জলান্ধরি, আল্লামা তাহের আল-কাদেরি, মাওলানা আবদুর রাজ্জাক সিকান্দার, মাওলানা ইউসুফ লুধয়ানবি, আবুল আসার হাফিজ জলান্ধরি, আগা শুরেশ কাশ্মিরি, মুশফিক খাজা, হাকিম মুহাম্মদ সাঈদ, আজমল খটক, মাওলানা ইসহাক ভাট্টি, বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ, ফারুক লেঘারি, মাওলানা ফজলুর রহমান, ড. আবদুল কাদের খান, নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান, মাওলানা শাহ আহমদ নূরানি, কাজি হোসাইন আহমদ, সায়েদ মনোয়ার হাসান, মাওলানা আজম তারেক, মাওলানা আবদুস সাত্তার খান নিয়াজি, ওয়াসিম সাজ্জাদ, প্রফেসর খুরশিদ আহমদ, নওয়াব আকবর বুগটি, এয়ার মার্শাল অবসরপ্রাপ্ত আসগর খান, শাহ মাহমুদ কুরাইশি, মোল্লা মুহাম্মদ ওমর, উসামা বিন লাদেন, আহমদ শাহ মাসউদসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পত্র সন্নিবেশ করা হয়েছে।
মাওলানা সামিউল হক শহীদ তার জীবদ্দশায় আত্মঘাতী হামলাকে ইসলামবিরোধী আখ্যায়িত করেছেন। একইসাথে পোলিও টিকা গ্রহণের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন। তার পুত্র হামিদুল হক হাক্কানি নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে, তিনি আফগান তালেবানের সাথে মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ের বিপরীতে তাদের সাথে আলোচনার পক্ষে ছিলেন। হামিদুল হক হাক্কানির শাহাদতে মাওলানা ফজলুর রহমানের প্রতিক্রিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, দারুল উলুম হাক্কানিয়া ও মাওলানা হামিদুল হকের ওপর হামলা আমার মাদরাসা ও ঘরের ওপর হামলা। রমজানুল মুবারকের শুরুতে একজন আলেমে দ্বীনের ওপর মসজিদে হামলা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা বলে অভিহিত করা হচ্ছে।
আমি অধমের মত হচ্ছে, নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে নিরাপত্তা ও আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার চাওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তানের সব মতাদর্শের উলামায়ে কেরাম কমপক্ষে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় হয়েছে। মাওলানা হামিদুল হক হাক্কানির শাহাদতকে জাতির ঐক্যের সূচনা পয়েন্ট বানানো হোক। মিল্লি একজেহাতি কাউন্সিলকে পুনরায় চাঙ্গা করা হোক অথবা কোনো নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠন করা হোক।
যেদিন পাকিস্তানের সুন্নি-শিয়া আলেম ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে, সেদিন ওই আলেমদের পরস্পর লড়াই করানোর ষড়যন্ত্রকারী অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যাবে। এখন তো অন্ধরাও দেখতে পাচ্ছে যে, পাকিস্তানের আশপাশে এক নতুন গ্রেট গেম শুরু হয়েছে এবং পাকিস্তানকে আরো একবার এ নোংরা খেলার অংশীদার বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পাকিস্তানকে এ নোংরা খেলা থেকে দূরে থাকা উচিত। পাকিস্তানকে এ নোংরা খেলা থেকে বাঁচানোর সর্বোত্তম পথ হচ্ছে সব মতাদর্শের উলামায়ে কেরামের ঐক্য। উলামায়ে কেরাম ঐক্যবদ্ধ হলে রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়ে যাবে। এ আলেমরা যদি এ মুহূর্তে এক না হন, তাহলে তাদের জন্য পুনরায় এক হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। কেননা, আগামীতে পাকিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নোংরা খেলা আরো এগিয়ে নেবে এবং আরো অনেক ব্যক্তিকে নিশানা বানাবে।
[পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর]
অনুবাদ- ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
– হামিদ মীর, পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাংবাদিক।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ