।। ফারুক ওয়াসিফ ।।
৭১-এর নায়ক থেকে বাকশালের একনায়ক, তারপর ভারতীয় ন্যারেটিভে বন্দি: মুজিবকে ঘিরে বাংলাদেশের দীর্ঘশ্বাস।
শোকের রাজনীতি আছে, বিরাট অর্থনীতিও ছিল। শোকের চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল যাবতীয় লুটপাট। শোকের রশিতে হাত-পা বাঁধা জনগণ বাঁধন আলগা করে বেহাত রাষ্ট্রকে হাতে আনতে চাইছে। এরকম সময়ে অনুশোচনাহীন শোকের পুরানা ন্যারেটিভ সন্দেহজনক।
শেখ মুজিব স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে শুধু পশ্চিম বাংলা নয়, ভারত থেকেও রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ভারতপন্থী ছিলেন না, যেটা তাজউদ্দীন, শেখ মনিরা ছিলেন। তিনি সেক্যুলার ছিলেন না, ছিলেন অসাম্প্রদায়িক।
শেখ মুজিব হত্যায় লাভবান হয়েছে ভারত ও আমেরিকা।
উঠতি মধ্যবিত্তের নেতা শেখ মুজিব রাষ্ট্রনায়ক হয়ে রাষ্ট্রটাকে পারিবারিক সম্পত্তি করে তুললেন। ইন্দো-রুশ-মার্কিন ষড়যন্ত্রে বেছে নিলেন ফ্যাসিবাদের পথ। ৫২, ৬৯, ৭১ এ তিনি জেলে ছিলেন। ঘরে ঘরে দুর্গের ডাক দিয়ে, আসন্ন গণহত্যার আয়োজন দেখেও তিনি জাতিকে অপ্রস্তুত রেখে পালিয়ে গেলেন, ধরা দিয়ে। বারবার তাঁর অনুপস্থিতিতেই জাতিকে বিপদ পার হতে হয়েছে। ৬৯ এ ভাসানী, ৭১ এ জিয়া লড়াইয়ের লাইন সেট করেছিলেন। ২৫ মার্চে নিরস্ত্র ও দিশাহীন অবস্থায় পাকিস্তানের গণহত্যাকারী সেনাবাহিনীর হাতে দেশকে ছেড়ে পালাবার দায় তিনি এড়াতে পারেন না।
তাঁরই পাকিস্তান ভাঙ্গার দায় নিতে না চাওয়ার ভুলের কারণে মুক্তিযুদ্ধ পায়ে হেঁটে ভারতের কাছে আশ্রিত হতে হয়েছিল (আহমদ ছফা’র লেখা বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা প্রবন্ধ)। এক কোটি শরণার্থীকে হাতে রেখে ভারত মুজিবনগর সরকারের ভাগ্যবিধাতা হয়ে উঠেছিল। আর আওয়ামী লীগ উঠতি মধ্যবিত্তের জাতীয় দল থেকে পরিণত হয়েছিল ভারতীয় দলে। সেই ভুলের খেসারত এই ২০২৫ এও বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে মুজিব যে আওয়ামী মসনদে বসেন, সেই মসনদে তাঁর জন্য বিপদজনক হয়ে উঠেছিল তাই। এ পার্টি কোনোদিন আর তাঁকে রক্ষা করে নাই, বরং ব্যবহারে ব্যবহারে নোংরা করে ফেলে।
পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ ভূমি। বাংলাদেশের তিন ভাগ মানুষের কাছে তিনি এক বিতর্কিত চরিত্র, এক ভাগের কাছে পূজিত। বাংলাদেশে ব্যক্তি পূজা চলে না, আজকে যিনি দেব কাল তিনি প্রেম। ব্যক্তিবন্দনা এক বহিরাগত জিনিস। এদিকে তাঁকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে সেই বহিরাগত ভারতীয় আধিপত্যবাদী আইডিওলজি। সুতরাং কোন মুজিবকে স্মরণ করছেন সে বিষয়ে হুঁশিয়ার: ভারত নির্মিত (শ্যাম বেনেগালের ফিল্মের) মুজিব, না বাস্তবের মুজিব?
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
স্বাধীন বাংলাদেশ গোড়া থেকেই লুটপাট আর স্বৈরাচারের কবলে পড়ার দায় তিনি ছাড়া আর কার? ৭০ সালের পাকিস্তানের বিধানসভার নির্বাচন তথা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের নির্বাচনের এমএলএ-দের দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বুজরুকির পার্লামেন্টে গঠনের দায় তাঁর। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কারচুপির দায় তাঁর। বাকশাল ঘোষণা করে একনায়কত্ব চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তিনি যে রাজনৈতিক আত্মহত্যা করলেন, সেই দায় তিনিসহ তাঁর দল ও মস্কোপন্থীদের। ৭১-৭৫ না বুঝলে মুজিব পরিবারের ট্র্যাজিক মৃত্যু এবং বাংলাদেশের সার্বিক ট্র্যাজেডি বোঝা সম্ভব? পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা থেকে ফ্যাসিস্ট বাকশালের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার মধ্যে উত্থান নয়, বরং পতনের পরিণতিই দেখা যায়।
শেখ মুজিব দেবতা নন। তিনি যখন মানুষকে ভালোবেসেছেন, মানুষ বহুগুণে তা ফিরিয়ে দিয়েছে। তিনি যখন মানুষের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, মানুষও তখন মুখ ফিরিয়েছে। সেই মুখ ফেরানো মুক্তিযোদ্ধা ও কমিউনিস্টদের তিরিশ হাজার তরুণকে রক্ষীবাহিনী দিয়ে তিনি খুন করিয়ে সংসদে ‘লাল ঘোড়া দাবড়ানোর’ উল্লাস করেছেন। সিরাজ শিকদার হত্যার পর দম্ভ ভরে বলেছিলেন, কোথায় আজ সিরাজ শিকদার’। হিন্দু সম্পত্তি দখলের হিড়িক শুরু তাঁর আমলেই। সিপিবি পাকিস্তান আমলে ইলা মিত্রের ওপর নৃশংতার নিন্দা করে কিন্তু মুজিবের বাহিনীর হাতে অরুণা সেনের ওপর বর্বরতা নিয়ে টু ফা করে না কেন?
শেখ মুজিবকে শারীরিকভাবে হত্যা করেছিল তাঁর শত্রুরা, কিন্তু তাঁর মেয়েরা যে তাঁকে রাজনৈতিকভাবে হত্যা করে গেল, তার কী হবে? তাঁর মেয়ের বিচার ছাড়া মুজিবের দ্বিতীয় মৃত্যুর প্রতিকার কীভাবে করা সম্ভব?
এত কিছু সত্ত্বেও নতুন মুক্তিযুদ্ধ জয়ী না হওয়া অবধি শেখ মুজিবুরকে ছাপিয়ে যাওয়া কঠিন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন আমাদের সকল রকম ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা দেয় যে, মুজিব কোনো আদর্শ নন। তাঁর মৃত্যু হয়তো অনিবার্য ছিল, তারপরও তা কোনো আনন্দ-উল্লাসের ঘটনা না।
শেখ মুজিবের তৃতীয় জন্ম কি সম্ভব? প্রথম মৃত্যুর পথে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল ৭২-৭৫ এর আওয়ামী লীগ, লীগার খোন্দকার মোশতাক যার একজন কারিগর। ২০০৯-২০২৪ এর আওয়ামী লীগের হাতে ঘটে তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যু, শেখ হাসিনা ও তাঁর প্রভু ভারত ছাড়া এই দায় আর কারো না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় আধিপত্য মুক্ত না হলে, শেখ মুজিবের আদি বাঙালদের জাতীয় নেতা হিসেবে ফিরে আসার আর পথ দেখি না। ইতিহাসের হিমঘরে কাল্ট লিডার হয়ে থাকা ছাড়া আপাতত তাঁর আর গতি নাই।
– ফারুক ওয়াসিফ
কবি, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
[লেখকের ১৫ আগস্ট (শুক্রবার)এর ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে]
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ