Home ওপিনিয়ন বাগরাম বিমানঘাঁটি কেন ফেরত চাইছেন ট্রাম্প?

বাগরাম বিমানঘাঁটি কেন ফেরত চাইছেন ট্রাম্প?

রিড স্ট্যানডিস: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছেন। বিষয়টি নিয়ে তালেবান সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা চলছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা আফগানিস্তানে আর মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি চান না। এরপরই ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেছেন, যদি তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বাগরাম বিমানঘাঁটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে না দেয়, তবে ‘খারাপ পরিণতি’ ঘটতে পারে। গত শনিবার ট্রাম্প তার ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে এই হুঁশিয়ারি দেন। ট্রাম্প লিখেছেন, ‘বাগরাম এয়ারবেস যারা তৈরি করেছে, আফগানিস্তান যদি সেই দেশের হাতে এটি না ফিরিয়ে দেয়, তাহলে খারাপ কিছু ঘটবে।’

বিশ্বের বৃহত্তম বিমানঘাঁটিগুলোর একটি হচ্ছে বাগরাম। এর ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ রানওয়ে ভারী কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এসব রানওয়েতে বোমারু বিমান এবং বৃহৎ কার্গো বিমান সহজেই ওঠানামা করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑট্রাম্প কেন বাগরাম বিমানঘাঁটি আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছেন?

তার কারণ সম্পর্কে অবশ্য কিছুটা আভাস দিয়েছেন ট্রাম্প। ব্রিটেন সফরকালে গত ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছেন, ‘বাগরাম বিমানঘাঁটির কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে, কারণ এটি চীনের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর কাছাকাছি অবস্থিত। আপনারা জানেন, চীনারা যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র বানায়, সেখান থেকে বাগরাম বিমানঘাঁটি এক ঘণ্টার পথ। এ জন্যই এই বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুবই মূল্যবান একটি সম্পদ। এ জন্যই আমরা এটি ফেরত নিতে চাইছি।’

ট্রাম্প এবং তার উপদেষ্টাদের যুক্তি হচ্ছে, এই বিমানঘাঁটি শুধু নিরাপত্তা ও কৌশলগত কারণেই নয়, একই সঙ্গে আফগানিস্তানের মূল্যবান খনিজসম্পদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিত করতে পারে।’ উল্লেখ্য, চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের ৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।

বাগরাম বিমানঘাঁটি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। ১৯৫০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এটি নির্মাণ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী ২০০১ সালে আফগানিস্তান দখল করার পর এই বিমানঘাঁটি তালেবানের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান পরিচালনার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান ছেড়ে আসার পর গুরুত্বপূর্ণ এই সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণে নেয় তালেবান।

ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদের শেষদিকে এসে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার জন্য কাতারের মধ্যস্থতায় তালেবানের একটি চুক্তি করেন। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন ২০২১ সালে ঘাঁটিটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে চলে আসার জন্য ট্রাম্প তার পূর্বসূরির সমালোচনা করেছেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, ওয়াশিংটনের উচিত ছিল চীনের কাছে অবস্থানের কারণে একটি ছোট বাহিনী, সেখানে মোতায়েন রাখা। এখন এই চিন্তা থেকেই ট্রাম্প বাগরাম বিমানঘাঁটি আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

ট্রাম্প এর আগে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওয়াশিংটন ইতোমধ্যেই আফগানিস্তানের সঙ্গে ঘাঁটিটি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে কথা বলছে। আমরা চাই এটি দ্রুত ফেরত দেওয়া হোক। যদি তারা না দেয়, তাহলে শিগগিরই আপনারা জেনে যাবেন আমি কী করব।’ তবে মার্কিন সেনারা আবার এই ঘাঁটি দখল করতে সামরিক অভিযান চালাবে কি নাÑসে বিষয়ে তিনি স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। এছাড়া তিনি চীনের কোন পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর কথা বলছেন, সে ব্যাপারেও খোলাসা করে কিছু জানাননি। তবে, পেন্টাগনের প্রধান মুখপাত্র সিন পারনেল সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রেসিডেন্টের নির্দেশে বিশ্বের যেকোনো স্থানে যেকোনো ধরনের মিশন বাস্তবায়ন বা কার্যকর করতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।

ট্রাম্পের বিশেষ দূত অ্যাডাম বোহলার এবং আফগানিস্তানে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জালমে খলিলজাদ গত ১৩ সেপ্টেম্বর কাবুলে তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেন। তালেবান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৈঠকে আফগানিস্তানে আটক আমেরিকানদের বিষয়ে ‘বিশেষভাবে’ আলোচনা করা হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

তবে, মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের খবর অনুযায়ী, বাগরামে মার্কিন সেনা উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে গত মার্চ মাস থেকেই চিন্তাভাবনা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু বর্তমান এবং সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, আবার বাগরাম ঘাঁটি দখল করা কার্যত আফগানিস্তান দখলের মতো হবে। এতে ১০ হাজারেরও বেশি সেনা, উন্নত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং বিশাল সামরিক সরঞ্জামের প্রয়োজন পড়বে। এমনকি তালেবান এই ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে মার্কিন প্রশাসনকে অনুমতি দিলেও ইসলামিক স্টেট এবং আল-কায়েদার হামলা ঠেকানো কঠিন হবে। পাশাপাশি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঝুঁকিও থাকবে।

প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প কেন চীনের পরমাণু অস্ত্র ও স্থাপনার কথা এভাবে প্রকাশ্যেই বলছেন? তিনি তার নির্বাচনি প্রচারের সময় দাবি করেছিলেন, বাগরাম বিমানঘাঁটি চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে তালেবান ট্রাম্পের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, চীনা বাহিনী নয়, বরং বাগরাম বিমানঘাঁটি তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।

নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ক্যাবিনেট মিটিংয়ে তিনি বলেছেন, তার আফগানিস্তান পরিকল্পনায় বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের জন্য নয়, বরং চীনের জন্যই এই বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কারণ, চীন যেখানে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে, সেখান থেকে বাগরাম এক ঘণ্টার পথ।

ট্রাম্প সম্ভবত আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় লোপ নূর নিউক্লিয়ার টেস্ট রেঞ্জের কথা বলেছেন। এটি জিনজিয়াং প্রদেশের সীমান্ত বরাবর প্রায় ২০০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। চীন প্রায় ৬০ বছর আগে এখানে তার প্রথম পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালিয়েছিল। স্যাটেলাইটের চিত্র থেকে দেখা যায়, চীন সরকার ২০১৭ সাল থেকে এই এলাকায় নতুন নতুন ভবন, সড়ক ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করছে। কিন্তু এই এলাকায় চীন কোনো পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন করে না, এগুলো উৎপাদন চীনের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন তার পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি জোরদার করেছে, যা উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) পরমাণু অস্ত্রের মজুত ৬০০-তে পৌঁছায়। প্রতিবছর তারা ২০ শতাংশ হারে তারা পরমাণু অস্ত্রের উৎপাদন বাড়াচ্ছে। এই আশঙ্কা থেকেই ট্রাম্প চীন সীমান্তের অনেকটাই কাছে অবস্থিত বাগরাম বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

কিন্তু তালেবান কর্মকর্তারা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের প্রস্তাবের জবাব দিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাকির জালালি বলেছেন, আফগানরা তাদের ইতিহাসে কখনোই আফগানিস্তানে কোনো দেশের সামরিক উপস্থিতি মেনে নেননি। সামরিক উপস্থিতির বাইরে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে যদি কেউ আলোচনা করতে চায়, তাহলে আমরা তা করতে প্রস্তুত আছি।

এদিকে, বাগরামে চীনা সেনাদের উপস্থিতি সম্পর্কে ট্রাম্পের বক্তব্যের জবাবে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান গত শুক্রবার বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল চীন।’ তিনি আরো বলেন, ‘আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ দেশটির জনগণেরই নির্ধারণ করা উচিত। এই অঞ্চলে উত্তেজনা ও সংঘাত সৃষ্টির কোনো চেষ্টা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।’

রেডিও ফ্রি ইউরোপ থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।