Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন মাযহাব মানা আপরিহার্য কেন?

মাযহাব মানা আপরিহার্য কেন?

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

।। মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ।।

হাদীসের আলোকে প্রথম প্রমাণ

হযরত হুযাইফা (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জানি না আর কতদিন তোমাদের মাঝে আমি বেঁচে থাকবো। তবে আমার পরে তোমরা আবু বকর ও উমর এ দু’জনের ইকতিদা করে যাবে। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, আহমদ)।

এখানে ইক্তিদা শব্দটি ব্যবহার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা ধর্মীয় আনুগত্যের অর্থেই শুধু এর ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রশাসনিক আনুগত্যের অর্থে নয়। আল্লামা ইবনে মঞ্জুর লিখেছেন অর্থাৎ যার সুন্নাত বা তরীকা তুমি অনুসরণ করবে তাকেই শুধু কুদওয়া বলা যাবে। কিছুদর পর তিনি আরো লিখেছেন “কুদওয়া এবং উসওয়া শব্দ দু’টি সমার্থক। উভয়ের অর্থ হল আদর্শ।” (লিসানুল আরব)।

দ্বীন ও শরীয়তের ক্ষেত্রে নবী ওলীগণের আনুগত্যের নির্দেশ দিতে গিয়ে কুরআনুল কারীমেও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, “এরাই হলেন হিদায়াত প্রাপ্ত। সুতরাং তোমরা এদেরই ইক্তিদা করো। তদ্রুপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত সম্পর্কিত হাদীসেও একই অর্থে এর ব্যবহার এসেছে। এছাড়া আরো অসংখ্য হাদীসে এই অর্থে ইক্তিদা শব্দটির ব্যবহার এসেছে। বলা বাহুল্য যে, দ্বীনী বিষয়ে কারো ইক্তিদা করার নামই হলো তাকলীদ।

হাদীসের আলোকে দ্বিতীয় প্রমাণ

বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আমর (রাযি.) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বান্দাদের হৃদয় থেকে ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ইলমের বিলুপ্তি ঘটাবেন না। বরং আলেম সম্প্রদায়কে উঠিয়ে নিয়ে ইলমের বিলুপ্তি ঘটাবেন। একজন আলেমও যখন থাকবেনা, মানুষ তখন জাহিল মূর্খকেও পথ প্রদর্শকের মর্যাদা দিয়ে বসবে। আর তারা বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে অজ্ঞতা প্রসূত ফাতওয়া দিয়ে নিজেরাও গোমরাহ হবে অন্যদেরকেও গোমরাহ্ করবে। আলোচ্য হাদীসে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় ফাত্ওয়া প্রদানকে আলেমগণের অন্যতম ধর্মীয় দায়িত্ব বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই সর্বসাধারণের কর্তব্য হবে শরীয়তের সকল ক্ষেত্রে আলেমগণের ফাত্ওয়া হুবহু অনুসরণ করে যাওয়া।

‘মাযহাব মানা আপরিহার্য কেন?’ প্রথম কিস্তি পড়তে এই লেখার উপর ক্লিক করুন

বলুন দেখি, তাকলীদ কি ভিন্ন কিছু? এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যখন কোথাও কোন আলেম খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাহলে সেই নাযুক মুহূর্তে বিগত যুগের হক্কানী আলেম মুজতাহিদগণের তাকলীদ ও অনুসরণ ছাড়া দ্বীনের উপর অবিচল থাকার আর কি উপায় হতে পারে?

মোটকথা আলোচ্য হাদীসের সারমর্ম এই যে, ইজতিহাদের যোগ্যতা সম্পন্ন আলেমগণ যতদিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকবেন, ততদিন তাঁদের কাছেই মাসায়েল জেনে নিতে হবে। কিন্তু যখন তাদের কেউ বেঁচে থাকবেন না তখন স্বঘোষিত মুজতাহিদদের দরবারে ভিড় না করে বিগত যুগের মুজতাহিদ আলেমগণের তাকলীদ করাই অপরিহার্য কর্তব্য। আলোচ্য আয়াত ও হাদীস ব্যতীত আর অসংখ্য আয়াত ও হাদীস এবং সাহাবায়ে কিরামের নজীর বিদ্যমান রয়েছে, এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধে যার সবগুলি আলোচনা করা সম্ভব নয়।

সর্বসাধারণের তাকলীদ

তাকলীদের অনেক স্তর রয়েছে এর মধ্যে প্রথম স্তর হলো সাধারণ মানুষের তাকলীদ। এই সাধারণ শ্রেণীটি আবার তিনভাগে বিভক্ত।
এক: আরবী ভাষা জ্ঞান বঞ্চিত এবং কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞ। এরা হয় নিরক্ষর অশিক্ষিত কিংবা অন্যান্য বিষয়ে সনদপ্রাপ্ত শিক্ষিত।
দুই: আরবী ভাষা জ্ঞানের অধিকারী হলেও নিয়মতান্ত্রিক ও প্রথামাফিক উপায়ে এরা হাদীস তাফ্সীর ও ফিকাহ্সহ শরীয়ত সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ইল্ম অর্জন করেনি।
তিন: হাদীস, তাফসীর ও ফিকাহ্ বিষয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত ও সনদধারী, তবে উসূলে হাদীস, উসূলে তাফ্সীর ও উসূলে ফিকাহ্ তথা মূলনীতি শাস্ত্রে এদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও প্রজ্ঞা নেই। তাকলীদের ক্ষেত্রে এরা সকলেই অভিন্ন সাধারণ শ্রেণীভুক্ত। এদের জন্য নির্ভেজাল তাকলীদের কোন বিকল্প নেই। মুজতাহিদের পদাঙ্ক অনুসরণই হলো এদের জন্য শরীয়তের পথ ধরে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একমাত্র উপায়। কেননা কুরআন সুন্নাহর মূল উৎস থেকে সরাসরি আহ্কাম ও বিধান আহরণের জন্য কখনো প্রয়োজন হবে উদ্দিষ্ট অর্থ নির্ণয়ের মাধ্যমে দ্ব্যর্থতা দরীকরণের, কখনো প্রয়োজন হবে দৃশ্যত বিরোধপুর্ণ আয়াত বা হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধনের। কখনো বা প্রয়োজন হবে দুইয়ের মাঝে অগ্রাধিকার নির্ধারণের। আর সাধারণ শ্রেণীর পক্ষে এ শুধু অসম্ভবই নয়, অকল্পনীয়ও বটে।

আরও পড়তে পারেন-

‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ

কোভিড-১৯ মহামারী এবং ইসলামের শিক্ষা: ফরহাদ মজহার

আদর্শবানরূপে নিজেকে গড়তে চাইলে চার গুণাবলী অর্জন করতে হবে

‘হিজাব’ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করে: মার্কিন গবেষক!

বিশ্বকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস

চার মাযহাব কেন?

এক অনিবার্য কারণ বশতঃ চার ইমাম ছাড়া অন্য কারো তাকলীদ সম্ভব নয়। কেননা চার ইমামের মাযহাব যেমন সুবিন্যস্ত গ্রন্থবদ্ধ ও সংরক্ষিত আকারে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে তেমনটি অন্য কোন ইমামের বেলায় ঘটেনি। তদ্রুপ সবযুগে সবদেশে চার মাযহাবের অসংখ্য বিশেষজ্ঞ আলেম বিদ্যমান আছেন। পক্ষান্তরে অন্য কোন মাযহাবের তেমন একজন আলেমও বর্তমানে নেই। ফলে সেগুলো সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা এখন আর কিছুতেই সম্ভব নয়। এ অনিবার্য কারণ না ঘটলে চার ইমামের মত অন্য ইমামদেরও তাকলীদ করা যেতো স্বচ্ছন্দে।

হাফেজ যাহাবীর বরাত দিয়ে আল্লামা আব্দে রউফ মুনাবী লিখেছেন, আমাদের আক্বীদা হবে এই যে, চার ইমামসহ সকল ইমাম ও মুজতাহিদই আহ্লে হকের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ইজতিহাদের যোগ্যতা বঞ্চিতদের উচিত, যে কোন এক মাযহাবের তাকলীদে আত্মনিয়োগ করা। তবে ইমামুল হারামাইনের কথা মতে সাহাবা তাবেয়ীগণসহ এমন কোন মুজতাহীদের তাকলীদ বৈধ নয়, যাদের মাযহাব পূর্ণাঙ্গ ও সুবিন্যস্ত আকারে আমাদের কাছে নেই। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বলা হয় যে, বিচার ও ফাত্ওয়ার ক্ষেত্রে চার ইমাম ছাড়া অন্য কারো তাকলীদ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা বর্তমানে চার মাযহাবই শুধু মূলনীতিমালাসহ সুবিন্যস্ত ও গ্রন্থবদ্ধ আকারে ইসলামী জাহানের সর্বত্র বিদ্যমান রয়েছে। পক্ষান্তরে অন্যান্য মাযহাবের অনুসারীদের অস্তিত্ব পর্যন্ত আজ ইসলামী জাহানের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এই প্রেক্ষাপটে গবেষক আলেমগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে ইমাম রা’যি বলেছেন, সাধারণ লোককে অবশ্যই বিশিষ্ট সহাবীগণের (সরাসরি) তাকলীদ থেকে বিরত থাকতে হবে। (ফয়যুল কাদীর)।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ্.) তার সুবিখ্যাত ঈক্বদুল যাইয়িদ গ্রন্থে একটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদের শুরুতেই লিখেছেন “চার মাযহাবে তাকলীদ সীমিত করণের মাঝে যেমন বিরাট কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তেমনি তা বর্জন ও লংঘনের মাঝে রয়েছে সমূহ ক্ষতি ও অকল্যাণ। তাছাড়াও তিনি দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, আমরা সেদিকে যাচ্ছি না।

ব্যক্তি তাকলীদ অপরিহার্য

এ সম্পর্কে মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাদাতা শায়খুল ইসলাম আল্লামা নববী (রাহ্.) লিখেছেন, “ব্যক্তি তাকলীদ অপরিহার্য হওয়ার কারণ এই যে, মুক্ত তাকলীদের অনুমতি দেয়া হলে প্রবৃত্তি তাড়িত মানুষ সকল মাযহাবের অনুকূল বিষয়গুলিই শুধু বেছে নিবে। ফলে হারাম হালাল ও বৈধাবৈধ নির্ধারণের এখতিয়ার এসে যাবে তার হাতে। প্রথম যুগে অবশ্য ব্যক্তি তাকলীদ সম্ভব ছিল না। কেননা ফিকাহ্ বিষয়ক মাযহাবগুলো যেমন সুবিন্যস্ত ও পূর্ণাঙ্গ ছিল না, তেমনি সর্বত্র সহজলভ্যও ছিল না। কিন্তু এখন তা সুবিন্যস্ত পূর্ণাঙ্গ আকারে সর্বত্র সহজলভ্য। সুতরাং যে কোন একটি মাযহাব বেছে নিয়ে একনিষ্ঠভাবে তা অনুসরণ করাই এখন অপরিহার্য।” (শরহুল মহাযহাব)।

শীর্ষস্থানীয় আলেম ও ফকীহগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, ব্যক্তি তাকলীদের উপর আমল তথা চার মাযহাবের যে কোন এক মাযহাব মেনে জীবন অতিবাহিত করা। ওয়ারিসে নবী হিসেবে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল তাঁদের উপর অর্পিত মহান দায়িত্বেরই অন্তর্ভুক্ত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন “গরিষ্ঠ অংশের অনুসারী হও”। আজ বিশ্বের মধ্যে ইমাম আবু হানীফার মাযহাব তথা হানাফী মাযহাবের লোকই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আসুন সবাই হানাফী মাযহাব মেনে চলি।

সুপ্রিয় পাঠক! উপরোল্লিখিত আলোচনা দ্বারা আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে, মাযহাব মানা আবশ্যকীয় এবং চার মাযহাব থেকে যে কোন একটি মেনে জীবন অতিবাহিত করাও আবশ্যকীয়।

আল্লাহ্ পাকের নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের সবাইকে সঠিক জ্ঞান দান করেন এবং আমাদেরকে সঠিক পথে চলার তাওফীক দান করেন। মওদদী ফিতনা ও অন্যান্য সমস্ত ভ্রান্ত মতবাদ থেকে আমাদেরকে হিফাযত রেখে ঈমানের সাথে মৃত্যু দান করেন। যতদিন জীবিত আছি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ ও সাহাবায়ে কিরামের অনুসরণে চলতে পারি। আমীন।

সহায়কগ্রন্থ:

১। তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন
২। আহ্কামুল কুরআন লিল জাসসাস
৩। তাফ্সীরে নুরুল কুরআন
৪। মাযহাব কি ও কেন?

লেখক: প্রিন্সিপাল- জামিয়া ইসলামিয়া ইমদাদুল উলূম নলজুরী, সিলেট এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মেসার্স আব্দুল মজিদ এন্ড সন্স, তামাবিল, সিলেট।

উম্মাহ২৪ডটকম: আরএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

আরো পড়তে পারেন- ‘করোনা মহামারী ও পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার আলামত’