Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিদ্যুৎ সেক্টরে অপচয় ও গণদুর্ভোগ চরমে

বিদ্যুৎ সেক্টরে অপচয় ও গণদুর্ভোগ চরমে

।। সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা ।।

দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরে অপচয় ও অনিয়ম কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। সরকার বিদ্যুৎ সেক্টর চালাচ্ছে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে। ফলে প্রতি বছরই এ খাতে সরকারকে বড় ধরনের লোকসান গুণতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো উৎপাদন মূল্যের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করায়- এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতির ওপর। ফলে এই ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারকে বারবার পাইকারী ও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। ফলে প্রান্তিক জনদুর্ভোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাচ্ছে। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের দেশের অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র অহেতুক বসিয়ে রাখার কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া বাবদ লোকসান দিতে হচ্ছে সরকারকে। মূলত চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করায় এই অনাকাঙ্খিত জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনোমিক্স ফাইনান্সিয়াল অ্যানালিসিসের (আইইইএফএ) এক প্রতিবেদনে এই দুর্ভাগ্যজনক চিত্র উঠে এসেছে।

মূলত আমাদের দেশে চাহিদার চেয়ে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। বাকি ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোন কার্যক্রমই নেই। তবুও সরকারকে কেন্দ্র ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। আর এই বাহুল্য খরচের কারণে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণও ক্রমবর্ধমান। জানা যায়, বিগত অর্থ বছরে এসব কর্মহীন বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। সঙ্গত কারণেই দেশের বিদ্যুৎ খাতের প্রকৃত চাহিদা পুনরায় নির্ধারণ করার সুপারিশ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি পক্ষ থেকে।

আরও পড়তে পারেন-

আদর্শ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সততা, ওয়াদা ও আমানত রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম

সঠিক নিয়্যাত ও একনিষ্ঠতাবিহীন ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না

‘আমার জীবনে কুরআনের প্রভাব কল্পনার চেয়েও বেশি’: ইউসুফ ইসলাম

স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রতি যত্নবান থাকতে ইসলামে গুরুত্বারোপ

আমি মনে করি নারীবাদ হলো স্রেফ এক ‘ভণ্ডামী’: ক্যানডেইস ওয়েনস

সম্প্রতি আইইইএফএ নিজস্ব ওয়েব সাইটে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের ওপর ‘বাংলাদেশ পাওয়ার রিভিউ ওভার ক্যাপাসিটি, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট, সাবসিডিজ অ্যান্ড ট্যারিফ আর সেট টু রাইজ ইভেন ফাস্টার’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)এর নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া বেসরকারি ও সরকারি কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ কেনার স্বল্প (রেন্টাল) ও দীর্ঘমেয়াদি (আইপিপি বা ইন্ডিপেডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) চুক্তি করে থাকে। এসব কেন্দ্রে ব্যবহৃত তেল, গ্যাস, কয়লা বা জ্বালানির মূল্য দেয় পিডিবি; দেওয়া হয় বিদ্যুতের দাম। সারা বছর কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি ইউনিট অর্থও বরাদ্দ থাকে।

এ ছাড়া কেন্দ্রর একটি ভাড়া দেওয়া হয়, যা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নামে পরিচিত। যখন কোনো কেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ নেয় না তখন এনার্জি ও বিদ্যুতের দাম দেওয়া বন্ধ থাকে কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ যথারীতি পরিশোধ করতে হয়। একটি ১শ’ মেগাওয়াটের কেন্দ্র করে বছরে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় প্রায ৯০ কোটি টাকা। সঙ্গত কারণে বিদ্যুতের প্রয়োজন না হলে কেন্দ্র অচল থাকায় বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসান হয়। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতির ওপর।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ২০১০ সালে বিদ্যুত বিষয়ক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০১৬ সালে আবার তা সংশোধন করা হয়। এই মহাপরিকল্পনায় দেশটি দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়াতে আমদানিকৃত কয়লা এবং তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর জোর দিয়েছে। যা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, এ ধরনের পরিকল্পনায় অন্যান্য দেশে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতের আর্থিক সক্ষমতা একেবারে প্রান্তিকতায় নেমে আনতে পারে। করোনা ভাইরাস মহামারি এ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ হয়েছে।

এতে বলা হয়, বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা অনুসারে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অব্যাহত থাকলে ২০২৯-৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হবে প্রকৃত চাহিদার চেয়ে ৫৮ শতাংশ বেশি। কর্মহীন অবস্থায় থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপুল পরিমাণ কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্নদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি বিদ্যুৎ বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়েছে। ফলে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প বাতিলের ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সম্প্রতি চীনা বিনিয়োগে মিশরে ৬ হাজার ৬শ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎপ্রকল্প অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে দেশটি। ঘটনাটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্রের বক্তব্য হচ্ছে, ‘অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব আমলে নিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস আমরা করেছি, সে অনুসারে হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি থাকবে’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার সাথে সাথে বিদ্যুতের চাহিদাও হ্রাস পাবে এবং ২০২৯-৩০ সাল নাগাদ চাহিদা আগের চেয়ে অনেকটাই কমে যাবে। ফলে কার্যক্রমহীন বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় অর্থনীতির জন্য অসনীয় হয়ে উঠতে পারে। করোনা মহামারি শুরুর পূর্ব থেকেই পিডিবি বড় ধরনের লোকসানে ছিল। জানা গেছে, গত অর্থ বছরে পিডিবিকে দেওয়া সরকারের ভর্তুকি আট হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। উৎপাদন খরচের চেয়ে কমদামে বিদ্যুৎ বিক্রি এবং লোকসান সামলানো ও নগদ অর্থের ঘাটতি মেটানোর জন্য এই ভর্তুকি দিতে হয়েছে।

আইইইএফএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এখন নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুতের দাম কমছে। ব্যয়বহুল আমদানিকৃত কয়লা ও এলএনজি এবং বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি ও উচ্চ মূল্যের বিদ্যুতের পথ থেকে সরে আসতে গেলে সৌর বিদ্যুতের স্থাপনে জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কেন্দ্র ভাড়া থাকে না। এতে একদিকে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মিটবে, অন্যদিকে জ্বালানী নিরাপত্তা আরও সুসংহত হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যুতের স্থাপনা অনেক বেশি, সে কারণে বিদ্যুতে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে তা বেসরকারি কোম্পানির মালিকদের পকেটে চলে যাচ্ছে। আইইইএফএ নতুন কিছু বলেনি, এসব অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে। এখন দরকার গোটা বিদ্যুৎ খাতের পুনঃমূল্যায়ন। বাস্তবে বাংলাদেশের কতটুকু বিদ্যুৎ দরকার সেটা নির্ধারণ করা অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই জরুরি। অন্যথায় বিদ্যুৎ খাতের এই লোকসান গোটা জাতীয় অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাবই ফেলবে না বরং জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দেখা দেবে।

সম্প্রতি ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই বেসরকারি কোম্পানিগুলো গত ১০ বছরে উঠিয়ে নিয়েছে ৫১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। বন্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০১৮ সালে পিডিবি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করেছে ৬ হাজার ২শ ৪১ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালে ৮ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। ভর্তুকির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা এভাবে তুলে দেওয়া হচ্ছে কিছু কোম্পানির হাতে।

ক্রমবর্ধমান ভর্তুকির লোকসান কমাতে সরকার বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। এমনকি বর্তমান সরকার এক্ষেত্রে রেকর্ডই করে ফেলেছে। বছরে শুধু একবার নয় বরং একাধিকবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দামে পরিবর্তনের বিধান রেখে সংশোধন করা হয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি আইন। সরকার পক্ষের দাবি, ভর্তুকির চাপ কমাতে দাম বাড়ানোর বিকল্প কোন পথ নেই। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকার এ বিষয়ে বিকল্প পন্থাও অবলম্বন করতে পারতো! তারা আশঙ্কা করছেন, যেহেতু শিল্পের মোট খরচের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ব্যয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে হয়, তাই নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে জনজীবন ও রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। ভোক্তা অধিকার সংস্থার পক্ষে বলা হচ্ছে, উৎপাদনে ৮ হাজার কোটি টাকা, বিতরণে ২ হাজার কোটি টাকা মোট ১০ হাজার কোটি টাকা অযৌক্তিকভাবে ব্যয় হচ্ছে। সরকারের ঘাটতি ৭ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। তাহলে কেন এই অযৌক্তিক ব্যয়ের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে; সরকারকেই কেন ভর্তুকি দিতে হবে ? কিন্তু সংশ্লিষ্টদের কাছে এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর মিলছে না।

মূলত, দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই অলস থাকছে। ক্যাপটিভ, নবায়নযোগ্য উৎপাদনসহ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট স্থাপিত সক্ষমতা ২২ হাজার ৭শ ৮৭ মেগাওয়াট। কিন্তু ক্যাপটিভ বাদে ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রকৃত উৎপাদন ছিল মাত্র ৯ হাজার ৩৬৩ মেগাওয়াট এবং এই দিনে সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৪ হাজার ১৬৫ মেগাওয়াট। ২০১৯ সালের ২৯ মে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। এই হিসাবে প্রায় ৪৪ শতাংশ স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা অলস পড়ে থাকছে। নতুন কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র অপেক্ষমাণ বলে অলস সংখ্যা দ্রুতই ৫০ শতাংশ ছড়িয়ে যাবে; যদিও বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্লানে মোট স্থাপিত সক্ষমতার ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে না রাখার নির্দেশনা রয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, চাহিদা বিবেচনা না করে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রে বহুবিধ অনিয়মতান্ত্রিক সুবিধা ও দায়মুক্তি দিয়ে বেসরকারি খাতে বেশ কিছু তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এগুলো কার্যক্রমহীন রেখে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ। আইপিপি নামক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বোঝা টানতে হবে ১৫ থেকে ২২ বছর। ২০২২ সাল পর্যন্ত আইপিপিগুলোর আয় করমুক্ত। অধিকাংশ ইউনিট অলস থাকায় এদের কারও কারও প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ছে ৭৫ (অ্যাগ্রিকো পাওয়ার সলিউশন) থেকে ৮১ টাকার (প্যারামাউন্ট বিট্রাক এনার্জি) মতো। অন্যদিকে, তেল আমদানিতেও নগদ প্রণোদনা পায় তারা। এদিকে দ্রুত বিদ্যুৎসঙ্কটের সাময়িক সমাধান হিসাবে শুরু হলেও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো চলছে ১০ বছর পরেও। পিডিবির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ছয় বছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে প্রায ৩৫ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। যা বেসরকারি খাত থেকে ক্রয়কৃত বিদ্যুতেরই প্রায় ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ।

সাধারণত বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা কিছুটা বেশি দামের নিশ্চয়তা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ কেনার বাধ্যবাধকতাকে শর্ত হিসেবে রেখে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু আমাদের বেসরকারি আইপিপিগুলোকে তৃতীয় পক্ষহীন চুক্তিতে তিন থেকে পাঁচ গুণ দামের নিশ্চয়তা দেওয়া রয়েছে বলে জানা গেছে। আছে ক্যাপাসিটি চার্জ, ওভারহোলিং চার্জ, তেল আমদানি প্রণোদনা, কর অবকাশ সুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ নানা ধরনের গ্যারান্টি। আছে সহজ শর্তের ঋণের সুবিধাও। মোট বিনিয়োগের অন্তত ১০ শতাংশ মূল্যের খুচরা যন্ত্রপাতি প্রতিবছর করমুক্ত সুবিধায় আমদানি করতে চায়। বিপিসির আমদানি করা তেলের মান নিয়ে প্রশ্ন (যদিও তা পরীক্ষিত) তুলে সেখানেও নতুন প্রণোদনা চায়! এমনকি ২০০৬ শ্রম আইনের কর-পূর্ব মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে রাখার বিধানও সংশোধন চাওয়া হয়েছে।

মূলত নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র উচ্চ জ্বালানি দক্ষতায় (ইফিসিয়েন্সি) একটানা কয়েক মাস চালু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম (প্লান্ট ফ্যাক্টর) হলেই তার স্থাপিত সক্ষমতার প্রায় ৭৫ শতাংশকে (প্লান্ট ক্যাপাসিটি) পরীক্ষিত সক্ষমতা হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশের আইপিপিগুলোর ঘোষিত সক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানে কারিগরিভাবে পরীক্ষিত নয়। ফলে এই সক্ষমতার হিসাবে বড় ধরনের গরমিল থাকার আশঙ্কা রয়েছে।

সামিট পাওয়ারের ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ৭শ মেগাওয়াট। কিন্তু এই কেন্দ্রগুলোকে কখনোই সক্ষমতার অর্ধেকেও ব্যবহার করা হয়নি। এই কথিত সক্ষমতা সুনামধারী তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে পরীক্ষিত হওয়া তো দূরের কথা, এই ১১টি কেন্দ্রের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ২০১৮-১৯ অর্থাৎ মাত্র এক অর্থবছরেই ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।

অনিয়ম ও দলীয় প্রভাবে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রে বহুবিধ অন্যায় সুবিধা ও দায়মুক্তির মাধ্যমে পাওয়া এই কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতাকে আন্তর্জাতিক কারিগরিভাবে নিরীক্ষা করে রাষ্ট্রের তহবিল সাশ্রয়ের সুযোগ অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বরাবরই উদাসীন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

দেশের বিদ্যুৎখাতের ব্যাপক লোকসানের ক্ষেত্রে সিস্টেম লসকেও দায়ি করা হয়ে থাকে। কিন্তু একথা কারো অজনা নয় যে, বিদ্যুৎ একটি কারিগরি খাত। তাই এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের সঞ্চালন লস ছাড়া কোনো ধরনের সিস্টেম লস থাকার যৌক্তিকতা গ্রহণযোগ্য নয়।

বৃহৎ দেশগুলো, যেখানে অতি দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনে বিদ্যুৎ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে, সেখানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ (যেমন ইউএসএ) সিস্টেম লস মেনে নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু আমাদের মত ছোট দেশে বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনে সিস্টেম লস ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই সবার আগে বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ হওয়া দরকার। এ ছাড়া নতুন সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র সঞ্চালন ও বিতরণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন সক্ষমতা, মানসম্পন্ন কারিগরি নকশা তৈরি এবং বৈদেশিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ব্যবহার ব্যবস্থাপনা উন্নত করে বিদ্যুৎ খাতকে সাশ্রয়ী করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।

মূলত আমাদের দেশের নেতিবাচক রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের দেশের বিদ্যুৎ সেক্টর। কারণ, এসব ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য না দিয়ে ব্যক্তি, দলীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ফলে দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরছে না। সরকার ভর্তুকি ও সিস্টেম লসের কথা বলে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদেরকে এই অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

– সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা, কবি, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট।

ফেসবুকে ঝগড়া-ঝাঁটিতে কার লাভ হয়?