Home শিক্ষা ও সাহিত্য কবিতার কথা (৩)

কবিতার কথা (৩)

।। মালেকা ফেরদৌস ।।

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

প্রাচীন সংস্কৃত কবিদের অনুরাগের রং একাকার হয়েছে প্রেমের কবিতায়। কবিতার রং হচ্ছে অস্তিত্বের রহস্যময়তা এবং আনন্দ।

কবিরা আজীবন অসীমের প্রতি, অধরা এবং অনন্তের প্রতি একটা দূরায়ণ টান ও আকর্ষণ অনুভব করেন। কোন এক সুদূর লোক থেকে কি যেন তীব্র ব্যাকুলতা না পাওয়ার বেদনা কবিকে কুড়ে কুড়ে খায়- “যদি জানতেম সে কিসের ব্যথা”। – রবীন্দ্রনাথ।

আধুনিক কবিরা সৌন্দর্যবোধ ও আধুনিকতার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। নান্দনিক কবিরা কখনো কখনো আর্দশের বৃত্ত ভাঙ্গেন। সমাজের নানা অসঙ্গতি থেকে একটি রক্তিম গোলাপকে ফুটিয়ে তোলেন। সমাজের নীতি আদর্শের বৃত্ত ভাঙ্গার জন ফরাসি কবি বোদলেয়ারকে কাঠ গড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। তার ‘লে ফ্ল্যার দু’মাল’ এবং গুস্তাভ ফ্লোবের ‘ মাদাম বোভারি’ উপন্যাসটি ফরাসি সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই মানুষের সহজাত আকর্ষণ বেশি থাকে। বই বিক্রি তাদের বিখ্যাত করে দেয়। এদিক দিয়ে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ভাগ্যবান। যিনি আমাদের দ্বিমাত্রিক ধারণা দেন- কড়ি ও কোমলে, ’মানসির, মানবিক মিলন ও চিত্রা’র উর্বশী, ’বিজয়নী’তে। আসলে—“Art is woeful because it is Art.

মালেকা ফেরদৌসের আরো কবিতা পড়তে পারেন-

‘প্রার্থনা’

‘শিরোনামহীন’

আমার বাবা

কড়া নাড়ে কেউ

মায়ের জন্য…

বিশ্বের সব বড় কবিরাই আদিম যুগের কোলাহলকে স্মরণে এনেছেন। সৌন্দর্যবোধ, শিল্প, সংবেদনশীল, আবেগপ্রবণ তারা অনেক সময় ক্ষত বিক্ষত ও রক্ত- ক্ষরিত এবং অস্তিত্বের যন্ত্রণায় অস্থির হন। যন্ত্র যুগের শক্তিমত্তার সাথে সম্পর্ক খোঁজেন। আমাদের কবি নজরুলও লিখতে গিয়ে নানারকম বাধার সমুক্ষিণ হয়েছেন, জেল জুলুম, হুলিয়া ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার মুখামুখি দাঁড়িয়েছিলেন। তারপরও সৌন্দর্যের প্রতি তার ছিল অপরিসীম টান।রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যবোধ ছিল বিস্ময়ের আর নজরুলের ছিল প্রেম ও দ্রোহের।
রবীন্দ্রনাথ যেমন পুরাণে, বেদে তার ঐতিহ্য খুঁজেছেন, নজরুলও তেমন কুরআনে, পুরাণে ঐতিহ্য খুঁজেছেন। যুগ যন্ত্রণাও তাঁদের ভীষণভাবে স্পর্শ করেছে।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর ও সময়ে সারা বিশ্বের সমাজ জীবনে বিপুল একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।বিশেষ করে ইউরোপে। তার ঢেউ সারা বিশ্বের শিল্পীদের নাড়া দেয় এবং একটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। সে যুগযন্ত্রণার যুগে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি সবাই এই বিশৃঙ্খলার হাত থেকে মুক্তি চাইলেন। সবাই একটা সুস্থ জীবনের কামনা করলেন। যেখানে দুর্ঘটনা থাকবে না, অস্বস্তি, থাকবে না, কারো হতাশা থাকবে না। এ সময়ে শিল্প, সংগীত, চিত্রকলা ও কবিতায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ পরিবর্তন গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে স্যুররিয়ালিজম। যাকে আমরা পরা বাস্তববাদ বলি।

বাস্তবতার ভেতরে নানা ধরনের পরিবর্তন, দুর্ঘটনা ঘটেছে, ছন্দ ভেঙ্গে গেছে, বিশৃঙ্খলা এসেছে, নীতিবোধহীনতার জন্ম দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সবাই একটা স্বপ্নের জগত কল্পনা করলেন। যেখানে সব কিছুই সম্ভব। যেখানে সময় একটা বিগলিত ঘড়ির মত গড়িয়ে চলে, নীলাভ আলোর মধ্যে মানুষ বাস করে। যেখানে একটি ফর্ম অবিকল বাস্তবের মত প্রতিভাত হয়। এভাবেই কবি, লেখক, শিল্পীরা স্যুররিয়ালিজমের জন্ম দিল। [চলবে]

– মালেকা ফেরদৌস, কবি, শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তক।

আরো পড়তে পারেন-

‘কবিতার কথা (১)’

কবিতার কথা (২)