Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ছোট জীবন, কম সময়, কাজ অনেক

ছোট জীবন, কম সময়, কাজ অনেক

।। মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী ।।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বর্তমানে মুসলিম সমাজ সাধারণভাবে সময় নষ্টের ব্যাধিতে আক্রান্ত। অথচ সময় হল, ব্যক্তি ও জাতির মূলধন। কোন জাতির অধঃপতনের প্রাথমিক লক্ষণ হল, মানুষজন ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সময় নষ্ট করার ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। ইউরোপীয় সমাজে নানা দুর্বলতা থাকলেও তারা সময়ের মূল্য দেয় এবং তাদের জীবনকে একটি নিয়মের অধীনে চালাতে অভ্যস্ত। পার্থিব জ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে তাদের উন্নতির অন্যতম প্রধান কারণ এটি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, যে জাতি সময়ের মূল্য দিতে জানে, তারা মরু ভূমিকে ফুলবাগিচায় পরিণত করতে পারে, আকাশ পথ জয় করতে পারে, পাহাড় ভেদ করতে পারে, মহাশূন্যে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং এভাবে যুগের নেতৃত্বের পতাকা তাদের হাতে এসে যায়। পক্ষান্তরে যে জাতি সময়ের মূল্য দেয় না, সময়ই তাদেরকে বিনাশ করে ছাড়ে। এরূপ জাতি গোলামীর জীবন যাপনে বাধ্য হয়, দ্বীন-দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে সব জাতি উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছে, তারা সবাই সময়ের মূল্য দিয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ যখন কয়েকটি শতাব্দী ধরে বিশ্বমানবতার সামনে নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তির পতাকা উড্ডীন রাখতে সক্ষম ছিল, তখন সময়ের মূল্য দেওয়া ছিল মুসলমানদের সাধারণ রীতি।

বস্তুতঃ সময়ের মূল্য দান করা মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য। তাদের ঐতিহাসিক বিশেষত্বও তাই। শত শত বছর ধরে তারা সারা দুনিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রসরমান ছিল এবং উন্নতির সোপানে আরোহণ করেছিল। তাদের জ্ঞান-বিদ্যার শিক্ষালয়ে তো সময়ের মান্যতা ছিলই, বিলাস প্রিয় ও প্রাচুর্যের অধিকারী শাসকদের দরবারেও এ শিক্ষা দেওয়া হত যে, অহেতুক কোন কাজে সময় ব্যয় করা যাবে না।

প্রসিদ্ধ আছে- বাদশাহ হারুনুর রশীদের দরবারে জনৈক ব্যক্তি ম্যাজিক দেখাবার অনুমতি প্রার্থনা করে। তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। সে তখন দরবারে হাজির হয়ে প্রথমে ফরাশের উপর একটি সুঁই খাড়া করে পুঁতে দেয় এবং কিছু দরে আরো কয়েকটি সুঁই নিয়ে দাঁড়ায়। তারপর সে একটি সুঁই নিয়ে ফরাশে পোঁতা সুঁই লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করে। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে দেখল যে, নিক্ষিপ্ত সুঁইটি পোঁতা সুঁইটির ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে গেল। এভাবে সে প্রায় দশটি সুঁই নিক্ষেপ করল। বাদশাহ হারুনুর রশীদ এ আশ্চর্যজনক নৈপুণ্য দেখে আদেশ করলেন যে, লোকটিকে দশটি দিনার এবং দশটি বেত্রাঘাত প্রদান করা হোক। উপস্থিত লোকেরা অবাক হল এবং এরূপ অভিনব পুরস্কারের কারণ জিজ্ঞেস করল। হারুনুর রশীদ বললেন, দশ দিনার হল, লোকটির মেধা ও নৈপুণ্যের পুরস্কার। আর দশ বেত্রাঘাত এজন্য যে, সে আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা ও মূল্যবান সময় এমন এক কাজে ব্যয় করেছে দ্বীন-দুনিয়ায় যার কোন ফল নেই।

মোট কথা, মুসলমানরা সময়ের মূল্যায়নে যতদিন সচেষ্ট ছিল, তত দিন তারা ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করতে পেরেছিল। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা বদলে গেছে। আমাদের পর্বসূরীদের অনুসরণ না করে আমরা আল্লাহর দেওয়া এই মহামূল্যবান নিয়ামত অনর্থক ব্যয় করে চলেছি। আর সেই কারণে আজ আমরা ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার পাশাপাশি দর্শন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজবিদ্যা ও আবিস্কারের দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের কি মেধা কম? আমরা কি দর্শন বুঝি না? জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমাদের কি কোনই অধিকার নেই? আমরা কি আবিস্কারক জাতি নই? যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগে, বীজগণিতের আবিস্কারক কে? সমাজ বিজ্ঞানের জন্মদাতা কে? নাইট্রিক এসিড আবিস্কার করেন কে? পৃথিবীর সর্বপ্রথম রাসায়নিক বৈজ্ঞানিক কে? দর্শনের ফেলোসফি শাখার জন্মদাতা কে? সবই মুসলমানদের অবদান।

প্রথম কিস্তি পড়ুন- ছোট জীবন, কম সময়, কাজ অনেক

বস্তুতঃ জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে মুসলমানদের পদচিহ্ন পড়েনি। এখনও যেসব জাতি উন্নতি লাভ করেছে, তারা বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভূগোল শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্য, মনোবিজ্ঞান প্রভৃতি যে কোন শাস্ত্রেই হোক না কেন, এ সবগুলোর প্রাথমিক স্তরসমূহের নির্মাণে ইসলামের ইতিহাসের ইল্মী শ্রম সাধনার রক্ত মেশানো রয়েছে। কিন্তু আফসোস! আজ মুসলমানরা তাদের ঐতিহ্য ভুলতে বসেছে। তাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সূর্যটা ডুবুডুবু করছে। এর অন্যতম কারণ, আজ তারা সময় থাকতে সময়ের মূল্যায়ন করছে না। বর্তমান কালে পশ্চিমারা বস্তুবাদী সভ্যতার যে রাজপথে পা রেখেছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতির যে পর্যায়সমূহ অতিক্রম করেছে এবং দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে উন্নতি লাভ করেছে, তার মৌলিক কারণ হল, পাশ্চাত্য সমাজে হাজারো দোষ থাকা সত্ত্বেও তারা সময়ের মূল্য দেয়। জনগণের যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর জন্য ক্ষেত্র সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে দর্শন ও বিজ্ঞানের বিষয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানের মনোভাব রয়েছে। সামাজিকভাবে কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা পশ্চিমা সমাজে নেই। ইংরেজদের সাথে অনেক বছর কাজ করেছেন এমন একজন কর্ণেল যথার্থই লিখেছেন- “এই ফিরিঙ্গি লোকেরা প্রেমও করে রুটিন মাফিক এবং প্রেমালাপ করার সময়ও তাদের একটি চোখ থাকে ঘড়ির দিকে, প্রয়োজনে ঘড়ির এলার্মও দিয়ে রাখে।”

সময়ের মূল্যায়ন করার কথা ছিল মুসলমানদের। কিন্তু তা পালন করছে পাশ্চাত্য সমাজ। দুঃখের বিষয়, মুসলমান জাতি আজ পাশ্চাত্যের অনুকরণে বিনা চিন্তায় নেমে পড়েছে। অশ্লীলতা, নগ্নতা, যৌনতা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার মত ধ্বংসাত্মক বিষয়ে তাদের অনুকরণ করছে। কিন্তু পাশ্চাত্য সমাজে যেসব জাগতিক ভাল দিক রয়েছে, মুসলমানরা তা গ্রহণ করেনি। মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত নবীনেরা, যারা জাতির ভবিষ্যৎ ও মূলধন, তাদের সময়ের একটি বিরাট অংশ মোবাইলে, কম্পিউটারে, স্যোশাল মিডিয়ায়, হোটেল-রেস্তোরাঁয় অনর্থক আড্ডায় ব্যয় হয়ে যায়। আড্ডায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প-গুজবের ন্যায় অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকা তাদের এক প্রিয় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ ছুটির সময়টা কোন রুটিন ছাড়াই এবং কোন অর্থবহ কাজ ছাড়া এমনিতেই চলে যায়। শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে যখন বের হয়, তখন তাদের সামনে থাকে না লক্ষ্য, থাকে না কোন কর্মপ্রতিজ্ঞা। জাতির কাছে তারা কি নিয়ে উপস্থিত হবে, তাও তারা বুঝতে পারে না।

আরও পড়তে পারেন-

দ্বীনি মাদ্রাসার ছাত্ররা আগে পরিশ্রম, পড়াশোনা ও ইল্ম হাসিলের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে ইলম ও পড়াশোনার আগ্রহ তাদের মধ্যে হতে চলে যাচ্ছে। বিলাসিতার প্রতি তাদের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। জীবনের মহান উদ্দেশ্য তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞানের পরিসর খুবই সংকুচিত হয়ে আসছে। তাদের মূল্যবান সময়ের অধিকাংশই ব্যয় হয় একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ও অহেতুক কথাবার্তায়। অধিক পরিমাণে অহেতুক সম্পর্ক রাখাই এমন এক ব্যাধি যা মানুষকে অকেজো করে ছাড়ে। তাই হে প্রিয় তালিবানে ইলম! এগুলোকে পরিহার করে চলতে হবে।

এবার আমরা সময়ের মূল্যায়নকারী কতিপয় অমুসলিম মনীষীদের নিয়ে আলোচনা করব। ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। তিনি রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন এবং সময়ের খুব মূল্য দিতেন। তিনি তার জীবনের একটি মিনিটও নষ্ট করতেন না। খাওয়া দাওয়া ও ঘুমানোর জন্য তিনি যথাসম্ভব কম সময় ব্যয় করতেন। তিনি যখন বালক, তখন তিনি একদিন তার পিতাকে দেখলেন যে, তিনি খাবার টেবিলে বসে প্রতিটি পেয়ালার জন্য পৃথক পৃথক ভাবে বরকত প্রার্থনা করছেন। ফ্রাঙ্কলিন ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, আপনি সবগুলো পেয়ালার বরকতের জন্য একবারেই তো প্রার্থনা করতে পারতেন। এতে অনেক সময় বেঁচে যেত। তিনি তার সবচেয়ে নাম করা গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন জাহাজে সফররত অবস্থায়।

স্যার ওয়াল্টার মটকের নিকট জনৈক ব্যক্তি উপদেশ চাইলে তিনি বল্লেন, তুমি সাবধান থাকবে। নিজের মধ্যে এমন প্রবণতা সৃষ্টি হতে দিবে না, যাতে তোমার সময় অনর্থক কেটে যায়। যা করতে হবে তা তৎক্ষণাত করবে। কাজের পর বিশ্রামের ইচ্ছা মনে আসতে দিবে না।

পিসাগোরাসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- সময় কি? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, সময় হল এ পৃথিবীর প্রাণ।

ওয়াশিংটনের নগর সেক্রেটারী একবার কয়েক মিনিট দেরী করে এসেছিলেন এই অজুহাতে যে, তার ঘড়ি পিছিয়ে ছিল। কর্মকর্তা বলেছিলেন, তুমি তোমার ঘড়ি পরিবর্তন কর, নইলে আমাকে সেক্রেটারী পরিবর্তন করতে হবে। আসুন! এবার কয়েকজন মুসলিম মনীষীর কথা জেনে নিই।

ইব্নে জাওযী (রাহ.) বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন। একদা মিম্বারে দাঁড়ানো অবস্থায় বল্লেন, অধম এ আঙ্গুল দ্বারা দুই হাজার খণ্ড কিতাব লিখেছে। বলা হয় যে, তাঁর কোন একটি মুহর্ত অযথা নষ্ট হত না। প্রতিদিন ৬৪ পৃষ্ঠা লিখার অভ্যাস ছিল। সুলাইম রাযী (রাহ.) একটু সময়ও অনর্থক নষ্ট করতেন না। লিখতেন, পড়তেন বা পড়াতেন। কলম কাটার সুযোগে মুখে যিক্র করতেন। আমীর বিন আব্দে কায়েস (রাহ.)কে এক ব্যক্তি বল্ল, আমার সাথে কথা বলুন। তিনি বল্লেন, সূর্যটাকে আটকিয়ে রাখুন, তবেই কথা বলব। ফখরুদ্দীন রাযী (রাহ.) প্রায় দু’শ’ কিতাব লিখেছেন। তিনি আল্লাহর শপথ করে বলেন, আমার আক্ষেপ হয় এজন্য যে, খাওয়ার সময় ইল্মের সাথে সম্পর্ক রাখা যায় না। কারণ সময় খুব মূল্যবান। আল্লামা শামসুদ্দীন ইস্পাহানী (রাহ.) অধিক আহার থেকে বিরত থাকতেন। কারণ এতে পানি বেশী পান করতে হবে, টয়লেটে যেতে হবে, সময় নষ্ট হবে। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী (রাহ.)এর সময়ানুবর্তিতা ছিল প্রবাদতুল্য। আরিফ বিল্লাহ ডা. আব্দুল হাই (রাহ.) আপন শায়খ সম্পর্কে বলেন, হযরত হাকীমুল উম্মতের নিকট সময়ের খুবই মূল্য ছিল। মনে হত যেন আল্লাহ তাআলা তাঁর স্বভাবের সাথেই সময়ের গুরুত্ববোধ সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন। প্রতিটি মুহর্তকে সঠিক ও যথাস্থানে ব্যয় করার প্রতি তিনি এতই গুরুত্ব দিতেন যে, সব সময় তাঁর দৃষ্টি থাকত ঘড়ির প্রতি এবং খুব সহজ ও স্বাভাবিকভাবে রুটিন মাফিক তিনি প্রতিটি কাজ সম্পাদন করতেন। তিনি সারা জীবন নিজের যাবতীয় কাজকর্ম ও প্রয়োজনাদি নির্দিষ্ট সময়ে একই সাঁচে গড়ে নিয়েছিলেন।

আবার দেখুন এমন নয় যে, তাদের আয়ুষ্কাল ছিল তাদের চাহিদা মত। বরং অধিকাংশই ষাট থেকে সত্তর বছরের হায়াত পেয়েছেন মাত্র। আবার দুনিয়াবী ঝক্কি ঝামেলা থেকেও তারা মুক্ত ছিলেন না। বরং তাদের জীবনেও ঝক্কি ঝামেলা বর্তমান কালের মতই ছিল। আসলে সবচেয়ে বড় কথা হল, তাদের জীবন ছিল সময় সূচী অনুযায়ী। তাদের কাছে সময়ের মূল্য ছিল এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য আদায় করার চিন্তা তাদের সব সময় থাকত।

তাদের বিশাল রচনা কীর্তির পিছনে মূল রহস্য এখানে নিহিত। মাওলানা মানাজির আহসান গিলানী (রাহ.) লিখেছেন, সে যুগের মনীষীদের গোটা জীবন নির্ধারিত সময়ের সাথে বাঁধা ছিল। সময়ানুবর্তিতার ফলেই তাদের ইল্মী ব্যস্ততা ও ত্যাগ সাধনার সাথে এমন বিস্ময়কর অবদান রাখতে তারা সক্ষম হয়েছেন। সময়ের সদ্ব্যবহার, অপচয় থেকে বাঁচানো এবং এ থেকে পরিপর্ণ মাত্রায় উপকার লাভ প্রসঙ্গে সময় নিয়ে গবেষণাকারীরা কতিপয় উপায় ও নিয়ম নির্ধারণ করেছেন। নিম্নে সেগুলো থেকে তিনটি প্রধান নিয়ম উল্লেখ করা হল-

রুটিনঃ

দিন রাতের সময়ের জন্য একটি সময় সূচী নির্ধারণ করা, ভবিষ্যতের সময়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট কাজের প্রোগ্রাম তৈরী করা এবং জীবনের পুরো সময়ের জন্য কাজসমূহের বিন্যাস ও সাজানোকে বলা হয় রুটিন বা নিযামুল আওক্বাত। প্রতিটি মানুষের দায়িত্বে বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করার ভার থাকে। সেসব কাজ আদায় করে দায়মুক্ত হবার সহজ, উত্তম উপায় হল এই যে, মানুষ প্রথম থেকে একটি রুটিন তৈরী করবে এবং তা মেনে চলবে। রুটিন তৈরী করার সময় কাজের আগপিছ নির্ধারণে সময় ও কাজ উভয়ের ধরণ ও প্রকার লক্ষ্য রাখতে হবে। দেখতে হবে কোন কাজ কোন সময়ে উত্তম ও সহজ উপায়ে সম্পন্ন হতে পারে এবং কোন সময় কোন কাজের জন্য বেশী অনুকূল পরিবেশ দান করবে।

জীবনকে রুটিনের অধীন করায় প্রচুর উপকার রয়েছে। একটি প্রধান উপকার হল, যখন পর্ব থেকে একটি প্রোগ্রাম নির্ধারিত থাকবে এবং আসন্ন সময়ের জন্য একটি কর্মসূচী নির্ধারিত থাকবে, তখন সময় এলে মানুষের মনোযোগ এমনিতেই তা সম্পন্ন করার প্রতি আকৃষ্ট হবে। আর এতে করে ইতস্ততঃ ও চিন্তাভাবনায় সময় নষ্ট হবে না। রুটিনের আরেকটি উপকার হল, এর কারণে প্রতিটি কাজ যথাসময়ে পুরোপুরি একাগ্রতার সাথে সম্পাদন করা যায়। নইলে সাধারণতঃ এই হয়ে থাকে যে, যখন কোন মানুষের দায়িত্বে অনেক কাজ থাকে এবং সেগুলোর জন্য কোন রুটিন থাকে না, তখন একটি কাজ করার সময় মন অন্য কাজে আটকে থাকে। এভাবে মানুষের মন তার অগোচরেই একটি অস্থিরতার শিকার হয়। তাই দরদর্শিতার দাবী হল, পর্ব থেকে একটি রুটিন তৈরী করে তার অধীনে জীবন পরিচালিত করা।

শরীরের যত্নঃ

মানব শরীরের সুস্থতা আল্লাহ তাআলার অতি মূল্যবান এক নিয়ামত। শরীরের সুস্থতা থাকলেই মন মস্তিষ্ক সুস্থ থাকে। সুস্থ শরীরেই সময়ের মূল্য দেওয়া ও যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হয়। মানুষ যদি রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, শরীর যদি ক্ষয় হতে থাকে, মনের কুসুম নির্জীব হয়ে যায়, তাহলে জীবনের আনন্দ আর থাকে না এবং পৃথিবীর প্রতিটি দৃশ্যই শুষ্ক মনে হয়। শারীরিক সুস্থতা সকল সুখের চাবিকাঠি। মন সতেজ থাকার নামই জীবন। ভাঙ্গা মনে বুলবুলের মিষ্টি সুরও মনে হয় যেন দুঃখের কান্না এবং ঘুঘুর মধুর গানও মনে হতে থাকে বেদনা ও বিরহের বিলাপ। শরীর ও মন উদাস থাকলে ফুলের শোভা এবং বাগান ও বসন্তের সৌন্দর্যও উদাসচিত্ত হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়। সুতরাং সময় ও জীবন দ্বারা গঠনমূলক কাজ নিতে হলে শারীরিক সুস্থতা রক্ষা ও যত্ন নেওয়া এক স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় বিষয়।

হিসাব গ্রহণঃ

কতটুকু লাভ হয়েছে আর কতটুকু লোকসান হয়েছে তা যাচাই করার নামই হিসাব। এ হিসাব ব্যক্তিগত পর্যায়ে হতে পারে। সামষ্টিক পর্যায়েও হতে পারে। হিসাব নেওয়ার পর অতীত সময় সম্পর্কে যদি গুরুত্বের অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তাহলে অযথা ব্যয় করা সময়ের জন্য অন্তরে অনুশোচনা আসে। আর অনুশোচনাই গন্তব্যের পথে চালিত করে। কেননা, এতে করে ভবিষ্যতে কোন সময় যাতে অযথা ব্যয় না হয়, সেদিকে সচেতনতা আসে। যদিও এ কথা সত্য যে, অতীতের জন্য আফ্সোস ও হারানো বস্তুর জন্য অনুতাপে আরো সময় নষ্ট হয়। তবে তা সে সময় সঠিক হবে যখন সে অনুতাপ ও আফসোস ভবিষ্যতের জন্য কোন নতুন প্রতিজ্ঞা ও প্রেরণার কারণ না হয়। হারানো সময়ের জন্য অনুতাপের ফলে যদি পুষিয়ে নেওয়ার প্রেরণা ও কাজের উদ্যম সৃষ্টি হয়, তাহলে এ অনুভূতি সময় নষ্ট করা নয়, বরং হিসাব গ্রহণের মূল উদ্দেশ্যই তো হল ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার উদ্যম ও কর্মের প্রতিজ্ঞা নতুন করে গ্রহণ করা।

পরিশেষে মনে রাখবেন, জীবন আমাদের ছোট। কাজ করার এবং অবদান রাখার সময় আমাদের কম। কিন্তু কাজ এবং দায়িত্ব অনেক বেশী। অর্থাৎ জীবন ছোট, সময় কম, কাজ অনেক! সুতরাং সময় সচেতনতা খুবই জরুরী। আল্লাহ আমাদের সকলকে সময়ের মূল্যায়ন করার তাওফীক দান করুন। আমীন॥

[ সময় সচেতনতা ও সময়ের মূল্যায়ন- প্রথম কিস্তি পড়তে এই লেখার উপর আলতো চাপ দিন ]

– মুফতী মনির হোসাইন কাসেমী, ফাযেলে- দারুল উলূম দেওবন্দ (দাওরা ও ইফতা), মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা এবং যুগ্মমহাসচিব- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।