Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘আগুন’ আর ‘আগুন’

পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘আগুন’ আর ‘আগুন’

।। হামিদ মীর ।।

প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজের মুখের দিকে বার বার হাত ঘুরিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাদেরকে বেশ কড়া ধমকের সুরে বললেন, এখন তোমরা একজন বদলে যাওয়া ইমরান খানকে দেখতে পাবে। যে নওয়াজ শরীফকে যুক্তরাজ্য থেকে ফিরিয়ে এনে সোজা কারাগারে নিয়ে একজন সাধারণ কয়েদির মতো করে রাখবে এবং আগামীকে তাকে মুক্ত করতে কারো চাপে বা অনুরোধে বিশেষ কোন অধ্যাদেশ জারি হবে না।

ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদে ‘টাইগার ফোর্সের’ অনুষ্ঠানে ১৬ অক্টোবর গুজরানওয়ালায় পিডিএমের সভায় নওয়াজ শরীফের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা বলেন, ‘নওয়াজ শরীফ তার বক্তব্যে কেবল সেনা প্রধানকে নয়, বরং পুরো সেনাবাহিনী উপরই আক্রমণ চালিয়েছেন’।

ইমরান খান জেনারেল বাজওয়ার প্রশংসা করে বলেন, সেনাপ্রধান রাষ্ট্রের প্রতিটি সঙ্কটে সরকারের পাশে থেকেছে। তাঁর বক্তব্য ইনসাফ ভিত্তিক। কিন্তু এত সমালোচনার পরও ইমরান খানের কণ্ঠ থেকে যেন ক্ষোভ কমছিল না। কারণ, বিরোধী দলের অনেক নেতা গ্রেপ্তার হলেও তখনও পর্যন্ত তাদের কেউ দোষী সাব্যস্ত হননি।

ইমরান খান হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেন, এখন আমি আমার আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে চোরদেরকে ধরব। তাঁর হুমকির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল এফআইএ এবং এফবিআর-এর প্রতি। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নওয়াজ শরীফের বক্তৃতার একটা অংশের উপর এত বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, যে কারণে পাকিস্তানের কোন টিভি চ্যানেল মি. শরীফের বক্তব্যের সেই অংশ প্রচার করতে সাহস করেনি।

গুজরানওয়ালার পরে পিডিএম করাচিতে একটি সমাবেশ করেছে। তবে রাষ্ট্রীয় কোন গণমাধ্যমে নওয়াজ শরীফের ভাষণ প্রচার করা হয়নি। কিন্তু এতদ সত্ত্বেও নওয়াজের ভাষণ অনলাইনে এতটা প্রচারিত হয়েছে যে, এই ভাষণ যে শোনেনি সেও ‘সার্চ’ করে বের করে শুনেছে। ১৬ই অক্টোবর রাতে নওয়াজ শরীফ যখন ভিডিও কনফারেন্সে ভাষণ শুরু করেছিলেন, তখন সেটা শোনার জন্য জনগণ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।

তিনি যখন জেনারেল বাজওয়ার কথা উল্লেখ করতে শুরু করলেন, তখন আমি আসিফ আলী জারদারের ঐ     বক্তৃতাকে স্মরণ করি, যখন তিনি ‘ইটের জবাব পাথর দিয়ে দেয়ার’ কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ সময় নওয়াজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জারদারির ওই বক্তৃতার পরে নওয়াজ শরীফ আসিফ আলী জারদারির সাথে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠক বাতিল করে দেন। নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করা হয়েছিল। কেননা মি. জারদারি তার বক্তৃতায় রাহিল শরীফের নাম উল্লেখ না করলেও ইটের জবাব পাথর দিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে কার্যত: সরকার ও সেনাপ্রধানকেই ইঙ্গিত করেছিলেন। কিন্তু তৎপরবর্তিতে মি. জারদারি ঠিকই ইটের জবাব পাথর দিয়ে দিয়েছিলেন এবং যেই মামলাগুলির শাস্তি বর্তমানে ভোগ করছেন, তা ঐ সময়ে দায়ের করা হয়েছিল।

গুজরানওয়ালায় দেয়া নওয়াজ শরীফের ভাষণ শুনে আমার মনে এই প্রশ্ন জাগল যে, তিনি জেনারেল বাজওয়াকে ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ধ্বংস করার জন্য দোষারোপ করেছেন। কিন্তু তাহলে কেন তাঁর দল জেনারেল বাজওয়ার মেয়াদ ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাড়ানোকে সমর্থন করেছিল?

ইমরান খান ও তার মন্ত্রীরা নওয়াজ শরীফের বক্তব্যের ক্রমাগত নিন্দা করেই চলেছেন। মনে হচ্ছে যেন দেশে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে, আর সবাই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করছেন তাঁরা সকলে। নওয়াজ শরীফের কিছু সগযোগী বিশ্বাস করেন যে, পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনও পাঞ্জাবের নেতা এইভাবে সেনাপ্রধানকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। আমি এই সহযোগীদের সাথে বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

কারণ, নওয়াজ শরীফের আগেও আরো এক নেতা সেনাপ্রধানের সমালোচনা করেছিলেন। নওয়াজ শরীফের মতো এই নেতাও লাহোরে জন্মগ্রহণ করে সেখানেই বেড়ে উঠেন এবং লাহোরেই তিনি নিজের পার্টি গঠন করে প্রথম নির্বাচনে জিতেছিলেন। আর এই সাফল্য এসেছিল পাঞ্জাবের মিয়াওয়ালি থেকে। আর এই নেতা আর কেউ নন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী  ইমরান খান খোদ নিজেই। নওয়াজ শরীফ ১৬ই অক্টোবর রাতে ইমরান খানকে লক্ষ্য করে যা বলেছেন, ২০০২ থেকে ২০১৩-এর মধ্যে একবার নয়, বহুবার ইমরান খান এই একই রকম ভাষায় হুমকি দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।

গুজরানওয়ালায় সমাবেশের পরের দিন কেন্দ্রীয় রেল মন্ত্রী শেখ রশিদ আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, নওয়াজ শরীফের বক্তব্যের পরে পিএমএল-এন নিষিদ্ধ করা উচিত। শেখ সাহেবের মনে রাখা উচিত যে, আদালতের মাধ্যমে যদি পিএমএল-এন নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তবে ইমরান খান নওয়াজ শরীফের কথায় ও সুরে যে ভাষণগুলো দিয়েছিলেন এর আগে, আদালতে তারও উল্লেখ করতে হবে।

আরও পড়তে পারেন-

ভাষণগুলির কথা আপাতত: রেখে আমরা ইমরান খানের আত্মজীবনীর প্রতি এবার একটু নজর দেই, যেটা ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ইমরান খান সেই বইয়ের ইংরেজি সংস্করণের ২২২ পৃষ্ঠায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে কী লিখেছেন? তা উল্লেখ করা আমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না। কারণ, আজকাল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনা ও অফিসারেরা প্রতিদিনই দেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন।

আমি ইমরান খানের কথাগুলো বার বার উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক অবমাননা করতে চাচ্ছি না। তবুও কিছু কথা উল্লেখ না করে পারছি না। বইয়ের ২২৩ পৃষ্ঠায় ইমরান খান আইএসআইয়ের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ‘মেজর জেনারেল এহতেশাম জমিরের’ সাথে তাঁর সাক্ষাত সম্পর্কে লিখেছেন। যেটা ছিল ইমরান খান থেকে ‘জেনারেল পারভেজ মোশাররফ’ গণভোটের সমর্থন চাচ্ছিলেন এই বিষয়ে।   

ইমরান খান জেনারেল পারভেজ মোশাররফের গণভোটকে সমর্থন করেছিলেন। যার পরে এহতেশাম জমির ধারণা করেছিলেন যে, ইমরান খান মহাজোটের জাতীয় জোটে যোগ দেবেন। কারণ, এই জোটটি ২০০২ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জোট সরকার গঠন করে। ইমরান খান তার আপত্তি জানিয়েছিলেন যে, তিনি অনেক চোর জড়ো হওয়া জোটে যোগ দেবেন না। তখন এহতেশাম জমির বলেছিলেন যে, দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানের মানুষ চোরদেরকেও ভোট দিয়ে থাকে।

আগ বেড়ে ইমরান খান দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন যে, দীর্ঘমেয়াদী সুবিধাগুলি পাওয়ার জন্য পাকিস্তানে স্বল্পমেয়াদী সুবিধা উত্সর্গ করা হয় এবং এটি আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির উত্তরাধিকার, যা সর্বদা কোনও আনুষ্ঠানিক বিস্তৃতি ভিত্তিক বিশ্লেষণ না করেই করে আসছে। আর এমন সিদ্ধান্তগুলিই দেশের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়।

২২৩ পৃষ্ঠায় ইমরান খান ২৩শে জুলাই, ২০০২ এ ‘জেনারেল পারভেজ মোশাররফ’-এর সাথে তাঁর বৈঠক সম্পর্কে লিখেছেন, এতে আইএসআইয়ের প্রধান উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে মোশাররফ তাকে আসন্ন জোট সরকারে থাকা রাজনীতিবিদদের নাম জানিয়েছিলেন। ইমরান খান মোশাররফকে বলেছিলেন যে, এই দুর্নীতিবাজদের সাথে সরকারে যোগ দিয়ে আমি আমার সুনাম নষ্ট করতে পারবো না। এর জবাবে মোশাররফ বলেছিলেন যে, আপনি যদি আমাদের জোটে যোগ না দেন তবে আপনি হেরে যাবেন। ২২৫ পৃষ্ঠায় ইমরান খান লিখেছিলেন যে, আমার প্রত্যাখ্যানের পরে আইএসআই আমার প্রার্থীদের হুমকি দেওয়া শুরু করে এবং তাদেরকে মুসলিম লীগে ঢুকানো শুরু করেছিল। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র আমার বিরুদ্ধে কাজ করছিল। ২০০৭ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সংবিধান স্থগিত করলে ইমরান খান আইনজীবীদের আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। আর ঐ আন্দোলনে তারা জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সম্পর্কে যেই ভাষা ব্যবহার করেছিলেন তা নওয়াজ শরীফের থেকে আরো বেশি ঝাঁঝালো ছিলো।

আজ ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী এবং নওয়াজ শরীফের পক্ষ থেকে জেনারেল বাজওয়ার উপর আরোপিত অভিযোগের নিন্দা করে চলেছেন। চলো! আমরাও নওয়াজ শরীফের অপবাদের নিন্দা করে দিচ্ছি। কিন্তু  ইমরান খানের দিক থেকে ‘জেনারেল পারভেজ মোশাররফ’ এবং আইএসআইয়ের উপর লাগানো অপবাদসমূহের কি নিন্দা করা হবে? যার আলোচনা তিনি তার ‘আত্মজীবনীতে’ লিখেছেন।

ইমরান খান তার বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, এখন আমার পার্টি পাকিস্তানে- ‘জঙ্গলের মধ্যে আগুনের বিস্তারের’ মতো ছড়িয়ে গেছে এবং  নওয়াজ শরীফকে তিনি তাঁর পকেটে পুরে নিয়েছেন। কিন্তু এখন সময় এসে গেছে, এই আগুনের উপর পানি ঢালার। এই জঙ্গল আমাদের সবার। যদি এই জঙ্গলে প্রতিশোধের আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে জঙ্গলে বসবাসকারীরা যাবে কোথায়?

[পাকিস্তানের বিখ্যাত পত্রিকা ‘জি নিউজ’ থেকে]

অনুবাদ: আল আমীন, শিক্ষার্থী- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।