Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইসলামই প্রথম মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে

ইসলামই প্রথম মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে

।। অধ্যাপক মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান ।।

ইসলাম ধর্ম ও মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিষয়টি বারবার আলোচনায় উঠে আসে। দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তিও ইসলাম এবং মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিষয়টিকে অনেকটা সমার্থক বলে মন্তব্য করে থাকেন। আমরা শিক্ষিত জনগণ সমাজ, দেশ ও বিশ্বের চলমান বিষয়ে বেশ সচেতন হলেও অতীত ইতিহাস ও বাস্তবতা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার সময়-সুযোগ পাই না।

অথচ কিছু কিছু ইতিহাস অবশ্যই প্রত্যেকের জানা উচিত এবং তা সঠিক কি না সে বিষয়টিও যাচাই-বাছাই করা বিবেকের দাবি। এ লেখার পক্ষে অনেক রেফারেন্স থাকলেও সবার জন্যই সহজলভ্য উইকিপিডিয়ার নির্ভরযোগ্য বিশ্বকোষের শরণাপন্ন হয়েছি। সত্যতা যাচাই করতে সেখানে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।

মধ্যযুগ বা মিডল এজেস কিংবা মিডিয়েবল পিরিয়ড হচ্ছে ইউরোপীয় ইতিহাস, যা পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। মধ্যযুগের শুরু হয়েছে রোমান সাম্রাজ্যের পতন দিয়ে। শেষ হয়েছে রেনেসাঁ বা এজ অব ডিসকভারি তথা আবিষ্কারের যুগ দিয়ে। পাশ্চাত্যের ইতিহাসকে ইতিহাসবিজ্ঞানীরা তিন ভাগে বিন্যস্ত করেছেন। ক্লাসিক্যাল, মিডিয়েবল ও মডার্ন।

আরও পড়তে পারেন-

আবার মধ্যযুগ বা মিডল এজকেও তিন ভাগে উপভাগ করা হয়েছে। যেমন- প্রাথমিক মধ্যযুগ (Early Middle Ages), উচ্চ মধ্যযুগ (High Middle Ages) এবং শেষ মধ্যযুগ (Late Middle Ages)। মধ্যযুগীয় বর্বরতা বা অসভ্যতা প্রধানত দেখা যায় মধ্যযুগের প্রথম ভাগে এবং নিশ্চিতভাবে তা শুধুই ইউরোপে। গণনিধন বা পাইকারি গণহত্যা (depopulation), শহর ও নগরজীবন থেকে জনসাধারণকে বলপূর্বক উচ্ছেদ (deunbanization) এবং এক গোষ্ঠী বা জাতি কর্তৃক অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপর বর্বর আগ্রাসন (barbarian invarions) প্রাথমিক মধ্যযুগে তথা লেট অ্যান্টিকুইটি (Late Antiquity) থেকেই অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। আগ্রাসী বর্বর জাতিগোষ্ঠী (ইউরোপীয় বেদুইন বা যাযাবর অসভ্য মানুষজন) পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের নানা অঞ্চলে নতুন নতুন রাজ্য স্থাপন করতে থাকে।

মধ্যযুগের এই প্রথম ভাগে রোমকেন্দ্রিক পশ্চিম রোম সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেলেও পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াজুড়ে তখনো পূর্ব রোম সাম্রাজ্য বা বাইজানটাইন এম্পায়ার শক্তিধর সাম্রাজ্য হিসেবেই বিরাজমান ছিল। মধ্যযুগের প্রথম ভাগে ইউরোপে খ্রিস্টান ধর্ম জুভায়িজম বা ইহুদিবাদী ধর্ম ও রোমান প্যাগানিজম বা রোমান পৌত্তলিকতা বা মিথলজিকে পরাস্ত করে ক্রমেই নিজের স্থান বিস্তার করে নেয় রাজকীয় শক্তি ও প্রশ্রয়ে।

ইউরোপীয় ইতিহাসকে প্রথম ঐতিহাসিক লিওনার্দো ব্রুনি (Leonardo Bruni) তাঁর ইতিহাসগ্রন্থ হিস্টোরি অব দ্য ফ্লুরেন্টাইন পিপলে (১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত) তিন ভাগে ভাগ করেন। ইউরোপীয় ইতিহাসকে এভাবে তিন ভাগে বিভক্ত করার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য মানে পরিণত হয় জার্মান ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার সেলারিয়াস (Christoph Cellarius) যখন ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর গ্রন্থ ইউনিভার্সাল হিস্টোরি ডিভাইডেড ইনটু এন এনসিয়েন্ট, মিডিয়েবল অ্যান্ড নিউ পিরিয়ড (Universal History Divided into an Ancient, Medieval and New Peried) প্রকাশ করেন।

ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের গবেষণা অনুসারে মধ্যযুগ শুরু হয়েছে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে তথা পঞ্চম শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশে, যদিও এ ব্যাপারে কোনো বিশ্বজনীন সিদ্ধান্ত হয়নি। ঐতিহাসিকরা ইউরোপীয় এ মধ্যযুগকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়েছে বলে ধরে নিলেও কেউ কেউ একে ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে বলেও লিখেছেন। উল্লেখ্য, আন্দালুসিয়া তথা মুসলিম স্পেনের রাজধানী কর্ডোভা ইউরোপীয় ক্রুসেডাররা দখল করেন ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে। বিজয়ী রাজা ফার্ডিন্যান্ড দ্বিতীয় মৃত্যুবরণ করেন ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে। কাস্টিলের রানি ইসাবেলা মারা যান ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে।

এ ছাড়া ইউরোপের ইতিহাসের এ তিন বিভাজনকে আরো সুনির্ধারণ করেন বেলজিয়ান ইতিহাসবিদ হেনরি পিরেন (Henry Pirenne) এবং ওলন্দাজ ইতিহাসবিদ জোহান হুইজিংগা। তাঁরা বিংশ শতকের প্রথম দিকে যে বর্ণনা দান করেন, তাতে মধ্যযুগের প্রথম অংশ ছিল ৪৭৬ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। উচ্চ মধ্যযুগ বিস্তৃত ছিল ১০০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। শেষ মধ্যযুগ ১৩০০ থেকে ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। সাধারণত ইউরোপের সমগ্র মধ্যযুগকেই অভিহিত করা হয় অন্ধকার যুগ বা Dark Ages বলে। মধ্যযুগের এই ইউরোপীয় বর্বরতার বা অন্ধকার যুগকে ঢালাওভাবে পুরোটাকেই নির্মম ও নৃশংস আগ্রাসন, গণহত্যা, নারী নির্যাতন, নারী হত্যা, অজ্ঞতা ও মূর্খতার কলঙ্কিত সময়কাল বলা যায় না। এর ভেতর অনেক ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়, যা কিনা ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোর গবেষণায় পাওয়া যায়। এ কথা সত্য, মধ্যযুগ কেবল ফারাঙ্গের বা ইউরোপের ইতিহাস। এ যুগের দোষ-গুণ যা, তা শুধু ইউরোপেরই।

এখানে আমাদের বিবেচ্য মধ্যযুগের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কী সম্পর্ক বা দূরত্ব ছিল, তা খতিয়ে দেখা। আমাদের নেতা, বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং শিক্ষিত বক্তাদের কেবল স্লোগান মার্কা সস্তা পপুলিস্ট বক্তব্য দিয়ে গেলে তাঁদেরও যেমন অসম্মান হয়, তেমনি জাতি হিসেবেও ক্ষতি হয় অনেক বেশি। ইউরোপে মধ্যযুগের প্রথম ভাগ যখন শুরু, তারও প্রায় শত বছর পর তথা ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইউরোপ থেকে বহু দূরে আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় আরবের সময়কালকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞতার যুগ বলা হলেও ইউরোপীয় মধ্যযুগের বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করলে তা ছিল নস্যি মাত্র। এর পরও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞা-দর্শনের ধর্ম ইসলাম তার যাত্রা শুরু করে ৬১০ খ্রিস্টাব্দে। জাজিরাতুল আরবে আইয়ামে জাহেলিয়াতের কবর রচনা করে মদিনা ও মক্কায় সূচনা করে এক মহাসভ্যতার, যার প্রশংসা করে বড় বড় গ্রন্থ রচনা করেছেন ইউরোপের মহান ঐতিহাসিকরা। মাইকেল এইচ হার্ট তাঁর লেখা ‘সেরা এক শ মনীষীর’ মধ্যে প্রথম স্থান দিয়েছেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে।

জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন, ‘এই সময়েই সেই আরবের মনীষী ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে পৃথিবীর শাসনক্ষমতা বুঝিয়ে দিলে তিনি একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব হতেন, যাঁর পক্ষে শান্তি ও সুখী পৃথিবী গড়া সম্ভব।’ কোরআন শরিফ, পবিত্র সুন্নাহ, মদিনা সনদ, বিদায় হজের ভাষণ, খোলাফায়ে রাশেদার যুগ থেকে শুরু করে এশিয়া আফ্রিকা ও ইউরোপের একাংশ মানব ইতিহাসের যে আলোকোজ্জ্বল বিশ্বসভ্যতা রচিত হয়- এগুলোই ইসলাম। এসবই হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুমহান আদর্শের অবদান ও উপহার। আরবে জন্মগ্রহণকারী প্রিয় মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় থেকে পবিত্র ধর্ম ইসলাম যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে সারা বিশ্বে আলো ছড়াতে থাকে, তা তো তথাকথিত ইউরোপীয় মধ্যযুগের কঠিন বর্বরতার বিরুদ্ধে মহাবিপ্লব হয়ে দেখা দেয়। আরবের আইয়ামে জাহেলিয়াতকে দূর করার পাশাপাশি ইসলাম ইউরোপীয় বর্বরতাকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে যে মহান আদর্শ ছড়িয়ে দেয়, তা কি গোয়েবলসীয় কায়দায়ই মিথ্যাচারের মাধ্যমে গোপন করা সম্ভব?

মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলতে যা বোঝানো হয় এর সঙ্গে ইসলামের মিল, সম্পর্ক বা সমর্থন বলতে বিন্দুমাত্রও ছিল না। ইতিহাস সাক্ষী, এখনো পবিত্র কোরআন আমাদের সামনে আছে। পবিত্র সুন্নাহও বিদ্যমান। মহানবী (সা.)-এর আলোকময় জীবনকাহিনীও মজুদ আছে। আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে যে ইউরোপীয় বর্বরতা ও অসভ্যতা তথা অন্ধকার যুগের আলোচনা তুলে ধরেছি, এর সঙ্গে ইসলামের যোজন যোজন দূরত্ব রয়েছে।

মধ্যযুগের ইউরোপীয় অজ্ঞতা, বর্বরতা, অসভ্যতা, গণহত্যা, নারী নির্যাতন, ক্রীতদাস প্রথা ইত্যাদির ইতিহাস একটু তলিয়ে দেখলে যেকোনো সত্যসন্ধানী সচেতন মানুষের কাছেই মধ্যদিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে, মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং প্রায় সমকালীন ইসলামী সভ্যতার দূরত্ব আকাশ-পাতাল। দুটি বিষয়ের সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ দ্বান্দ্বিক। সেই আদর্শিক দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধে মধ্যযুগীয় বর্বরতার পরাজয় ঘটেছিল। জয় হয়েছিল ইসলামী সভ্যতার।

মানুষ আপন করে নিয়েছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মহান আদর্শকে। এ কথাও সত্য, ইউরোপীয় মধ্যযুগের বর্বরতার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলের কিছু মিল পাওয়া যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে সে সময় ইসলামের যে সভ্যতা উচ্চতার চূড়ান্তে আরোহণ করেছিল, এর সঙ্গে ইউরোপীয় মধ্যযুগের বর্বরতার তুলনা করা খুবই অনুচিত, অন্যায় ও মূর্খতা। বরং ইসলামই প্রথম মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

লেখক : পরিচালক, গবেষণা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।