Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বাজেটে কতটুকু পাল্টাবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য?

বাজেটে কতটুকু পাল্টাবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য?

সারাবছর রোদবৃষ্টিতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করেও দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির এক বিশালসংখ্যক মানুষের ভাগ্যের চাকা সহজে ঘোরেনা। এই জনগোষ্ঠির বেশিরভাগ মানুষই সমাজে অবহেলিত। জীবন ও জীবিকার তাগিদে এরা নানা বৈচিত্র্যময় পেশায় জড়িত থাকলেও এদের আয় হয় অত্যন্ত কম ফলে এদের জীবন চলে অত্যন্ত কষ্টে। প্রকৃতপক্ষে এসমস্ত প্রান্তিক দরিদ্র মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে যে ধরনের টেকসই পরিকল্পনা প্রয়োজন তা এদেশে তেমনিভাবে হতে দেখা যায়না।

এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য যা বাজেট হয় তাও অনেকসময় তাদের কাছে পৌঁছেনা অথবা যা পৌঁছে তা নিতান্তই কম তাদের জীবন চলার মত যথেষ্ট নয়। এমতাবস্থায় চলতি জুনের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে। বাজেটে টাকার অংক বেশ বিশালই। তবে প্রতিবছরই বাজেট আসে, বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ থাকে; কিন্তু বাজেটের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্টির জন্য কিছু থাকলেও তা একেবারে নগণ্য।

আরও পড়তে পারেন-

এবারও তাই হয়েছে। এসব প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দ দিয়ে এতো বিপুলসংখ্যক প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন যে আদৌ সমম্ভব নয় এ বিষয়টা আমরা অনেকেই তলিয়ে দেখিনা। আসলে আমাদের সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কারা এই বিষয়টি অনেকের কাছেই অষ্পষ্ট, মূলতঃ অর্থনৈতিক বিবেচনায় প্রান্তিকতা হচ্ছে মানুষের চরম অর্থনৈতিক নিন্মাবস্থা। অর্থনীতে যাদের কোনো অবদানই নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সবকিছুতেই তারা পিছিয়ে। বলতে গেলে মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে তারা সমাজের মূল স্রোতের মানুষগুলোর চেয়ে খুববেশি পিছিয়ে থাকায় তাদের জীবন চলে চরম কষ্টে। অনেক সময় অবস্থানগত কারণে সমাজের মানুষ এদের কোনো মূল্যই দেয়না ফলে এরা সবসময় পড়ে থাকে সমাজের এককোণায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মানুষ হয়ে।

বহুল জনতা ও জাতি-গোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশ। এখানে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় দীর্ঘকাল থেকে অবহেলিত এবং অনগ্রসর। দেশের দলিত ও হরিজন সম্প্রদায় চরমভাবে অবহেলিত। তারা নিজ পেশার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সমাজের সেবা করছে। তারা আমাদের সেবাশ্রমিক। যেমন- জেলে, কামার, কুমার, মুচি, ঋষি, বেহারা, নাপিত, ধোপা. হাজাম, নিকারি, পাটানি, তেলি, ডোম, বাঁশফোর, তেলেগু ইত্যাদি। এসব সম্প্রদায় সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত।

দেশে আছে ‘বেদে’ সম্প্রদায়। যারা যাযাবর শ্রেণি। মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, টোলা, রিরসিকারী, সান্দার, গাইন বেদেসহ আটটি গোত্রে বিভক্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। তাদের পেশা তাবিজ বিক্রি, সর্পদর্শন চিকিৎসা, সাপের খেলা দেখানো, আধ্যাত্মিক চিকিৎসা ইত্যাদি। এরা বর্তমান করোনাকালে করুণভাবে জীবনযাপন করছে।

জনবৈচিত্র্যের এই দেশে বৃহত্তম বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও ৪৫টির বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। পাহাড় সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। তারা বেশির ভাগই ভূমিহীন, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। এসব প্রান্তিক মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহে গারো, কোচ, বানাই, ঢালু, হাদি ও বর্মণ জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চংগ্যা, ম্রো, লুসাই, বোম, পাংখো জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। উত্তরবঙ্গে সাঁওতাল, মুণ্ডা, মাহাতো, ওঁরাং, মালো, পাহান, সিং, মাহালি, পাহাড়িয়া বসবাস করছে। কক্সবাজারে রাখাইন এবং সিলেটে গারো ও খাসিয়া উপজাতি বসবাস করছে। বর্তমান করোনাকালে তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর  হিসেব মতে, দেশে মোট বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৪৩টি। যেখানে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ২২ লাখ ৩২ হাজার। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে সারা দেশের অসহায় মানুষগুলো বস্তিবাসী হচ্ছে। এসব মানুষ প্রান্তিক জীবন যাপন করছে। মানুষ হিসেবে তারা মৌলিক অধিকারবঞ্চিত। জীবন প্রত্যাশা বলতে তাদের কিছুই নেই। এরা জীবন যাপন করে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে। এসব প্রান্তিক মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বলতে গেলে যুগযুগ ধরেই খারাপ।  এসব প্রান্তিক জনগোষ্টির প্রায় ৩৯ শতাংশ পরিবারের কোন নিজস্ব জমি নেই। করোনাকালে এসব জনগোষ্টির বেশিরভাগ মানুষই অতিকষ্টে জীবনযাপন করছে। কেউ কেউ ছোটখাটো কাজ কর্ম করলেও দীর্ঘ মহামারিতে তাও তারা হারিয়েছে।

অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়িই এ করোনাকালে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে।  অনেক কিন্ডারগার্টেন এবং নন এমপিও শিক্ষক এ করোনাকালে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে অসহায় হয়ে পরেছে। এদের অনেকেই তাদের পেশার পরিবর্তন করে মানুষের কাজ করে পরিবারের ভরণপোষণ চালানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই বাজেটে সরকারের উচিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ এসব মানুষদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা। শুধু বরাদ্দ রাখলে চলবেনা সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনকে লক্ষ রাখতে হবে এসব বরাদ্দ অসহায় মানুষগুলো পাচ্ছে কিনা।

আমরা প্রত্যাশা করবো, সরকার ২০২১-২০২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্টির বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে একটি কার্যাকরি পদক্ষেপ নেবেন এবং তাদের জন্য সম্মানজনক বিশেষ বরাদ্দ রাখবেন। মূলত করোনাকালীন বাজেট বলেই এই বাজেটে অনেক বিষয়েই চমক থাকতে পারে কারণ করোনাকে জয় করতে হলে বাজেটে এবিষয়ে যে বিভিন্ন দিকনির্দেশনাসহ বরাদ্দ থাকবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত করেই বলা যায়, তবে এরই মধ্যে দেশের প্রান্তিক এবং কিছু করোনাকালীন সময়ে ভূক্তভোগী মানুষের জন্য সরকার বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখবেন এমনটিই প্রত্যাশা সকলের।

লেখক: রতন কুমার তুরী কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।