Home সাক্ষাৎকার ইসলামি বইমেলার প্রয়োজনীয়তা ও প্রত্যাশা: যা ভাবছেন শিক্ষার্থীরা

ইসলামি বইমেলার প্রয়োজনীয়তা ও প্রত্যাশা: যা ভাবছেন শিক্ষার্থীরা

প্রতিবছর রবিউল আউয়াল মাসব্যাপী রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের দক্ষিণ গেইটে ‘ইসলামী বইমেলা’র আয়োজন করে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন।’ প্রথম দিকে প্রচার প্রচারণা না থাকায় বইপ্রেমীদের মনোযোগ আকর্ষণ না হলেও বিগত দুইবছর বিভিন্ন ঘরনার ইসলামী সেলেব্রিটিদের সরব পদচারণা ও রাজধানী’সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বইপ্রেমীদের প্রানবন্ত উপস্থিতিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে ‘ইসলামী বইমেলা।’

এই মেলার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? মেলা কতৃপক্ষের নিকট পাঠকদের প্রত্যাশা কি? এবিষয়ে মতামত চাওয়া হয় রাজধানীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মাদরাসা শিক্ষার্থীর কাছে। তাদের মতামতগুলো পাঠকদের সামনে তুলে ধরছেন উম্মাহ২৪ ডটকমের নিজস্ব প্রতিনিধি- মুহাম্মদ নূর হোসাইন।

জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার শিক্ষার্থী মারুফ আল মাহমুদ বলেন- কয়েকবছর আগেও ইসলামি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ইসলামি বইমেলার চিত্র বর্তমান বইমেলার মতো ছিলো না। খোয়াবনামা, তাবিজের বই, খেজুর-মধু বিক্রয়ের স্টল দিয়ে চলতো মেলা। দক্ষিণ গেইটের সামনে দিয়ে পথচারীরা হেঁটে গেলে ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেতো না পাশেই চলছে ‘বইমেলা।’

তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, কয়েকবছর ধরে ইসলামি অঙ্গনের অভিজাত প্রকাশনীর অংশগ্রহণে চলমান ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ওয়ার’-এ ইসলামি বইমেলা বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া আমাদের হাতে নেই। প্রচারের ক্ষেত্রে আয়োজকদের গা-ছাড়া ভাব। রয়েছে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা। শত বাধা-বিপত্তির মাঝেও এবারের ইসলামি বইমেলা বেশ জমজমাট। পাঠকের আনাগোনাতে গমগম করছে মেলা প্রাঙ্গন। পাঠকেরা এক ছাদের নিচে সকল জনরার বই পেয়ে বই কিনে হাসিমুখে ফিরে যাচ্ছে।

মেলা কতৃপক্ষ আগামীতে আরও বৃহৎ পরিসরে স্থানের পরিধি বৃদ্ধি করে ‘ইসলামি বইমেলা’ আয়োজন করবেন বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।

জামিয়া আরাবিয়া এমদাদুল উলূম ফরিদাবাদের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান সালেহী বলেন- ওহি থেকে বহি আর বহি থেকে বই! সেই বিবেচনায় ইসলামি বইমেলা আসমানী ওহির একত্রস্থল বলা যায়। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি শুধু একটি বইমেলাই নয় বরং সেকুলার সুশীলদের নিরব চপেটাঘাতের বিস্তর আয়োজন। তাছাড়া ইসলামি বইমেলাকে কেন্দ্র করে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব সৃষ্টি হচ্ছে দেশে। যা আগামীর বাংলাদেশকে ইসলামের শান্তির রঙে রাঙাতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আমার মনে হয়। সুতরাং এটা শুধু প্রয়োজনই নয় বরং আরো বৃহৎ আকারে আয়োজন করা প্রয়োজন।

তিনি প্রত্যাশা করেন, এটি যেন নিছক আনন্দ অনুষ্ঠান ও মিলনমেলায় রুপান্তর না হয়। বরং এই বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে বাংলা সাহিত্যে আমাদের চুড়ান্ত দখল বাস্তবায়িত হয়। পাশাপাশি ওহির আলোকছটায় দেশের মুসলিম উম্মাহ পুরোপুরি আলোকিত জীবনের সন্ধান খুঁজে পায়।

জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন- আধুনিকতার এই যুগে মানুষ ক্রমে’ই পাঠনির্ভর হওয়ার পরিবর্তে স্রোতনির্ভর হয়ে উঠছে। অথচ ইসলামী জ্ঞান-গরিমার প্রগাঢ়তা নিহিত পাঠমগ্ন হওয়ার সাথে।মেলার সৌজন্যে—লেখকদের সংস্রব ও পাঠকদের মিলনে পাঠবিমুখরাও পাঠনুরাগী হয়ে উঠে। ‘ইসলামী বইমেলা’ মানে ইসলামী তাহজিব-তামাদ্দুম ও সংস্কৃতির এক উৎসবমুখর পরিবেশ।পাঠক এতে উপস্থিত হয়ে উক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে উৎসাহিত ও আন্দোলিত হয়। ফলে এই পাঠকদের মাধ্যমে একটি ইসলামী আদর্শিক সমাজ গঠন কামনা করা যায়। অতএব ইসলামী বইমেলা শুধু বই বিপণন নয়, বরং ইসলামী সাহিত্য-সংস্কৃতির বিপ্লব ঘটার মাধ্যমও বটে—বলে আমি মনে করি।

তিনি প্রত্যাশা করেন, ইসলামী বইমেলায় অধিক হারে সমাগম, লেখকদের সংস্পর্শ ও প্রকাশনীদেরকে উৎসাহের ক্ষেত্রে নিজ নিজ স্থান থেকে সন্তুষ্টজনক ভূমিকা রাখলে আগামীতে মেলা থেকে ইসলামী আদর্শিক সমাজ বিনির্মাণের আরো বেশি সম্ভাবনার আশা রাখতে পারবো, ইনশাআল্লাহ।

উত্তরা জামিয়াতুন নূর আল কাসেমিয়ার শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম বলেন- বাঙালি মুসলিমের প্রাণের মেলা ইসলামী গ্রন্থমেলা, আমাদের আবেগিত মনের অনুভূতি আদান-প্রদানের মেলা ইসলামী বইমেলা। আবহমান কাল থেকেই আমাদের দেশে হরেক রকমের মেলার আয়োজন হয়ে আসছে, তন্মধ্যে ইসলামী বইমেলা হলো সর্বোকৃষ্ট মেলা; যেখানে সুস্থ জ্ঞানের বিনিময় ঘটে ইসলামি বইয়ের মাধ্যমে। বইপড়া ব্যতীত সুস্থ জ্ঞানার্জনের সঠিক পথ নেই। তাই সুস্থ জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। বই হলো মানুষের জাগতিক, মনোস্তাত্মিক, নৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চমার্গে উপনীত হওয়ার প্রধান সোপান। ‘যে জাতি যত শিক্ষিত, সেই জাতি তত উন্নত।’ আর সুশিক্ষার জন্য ইসলামী বই-ই আলোকিত জগতের দিশারী। ইসলামী বইমেলা মুসলিম উম্মাহ’র জন্য অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।

তিনি বলেন, বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক যত নিবিড় ও ঘনিষ্টতর হবে, সেই মানুষ তত উন্নত চিত্তের অধিকারী হবে। আর মহান আল্লাহ পাক তো শুধু রিজাল ( নবী-রাসুল সা.) পাঠাননি। বরং কিতাব (বই)ও সাথে পাঠিয়েছেন। সুতরাং আলোকিত মানুষ গড়তে বই ও বইমেলার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

আরও পড়তে পারেন-

তিনি মনে করেন, মেলা কর্তৃপক্ষকে আরো পরিকল্পিতভাবে আয়োজন করতে হবে। আরো অনেক বেশি আন্তরিক হতে হবে। মেলাকে সফল করার জন্য সকলকেই উদ্যোগী হতে হবে। আয়োজক, প্রকাশক, ক্রেতা ও লেখক সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। মানুষের চাহিদা অনুসারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বইপ্রেমীদের বিশেষ আগ্রহ থাকে প্রিয় লেখকের সাক্ষাত লাভের। ব্যবস্থাপনা পর্ষদ এর জন্য লেখককুঞ্জ রাখতে পারেন। সেখানে প্রতিদিন প্রতিষ্ঠিত নানা লেখক থাকবেন। যাদের বই পড়ে এত দিন প্রাণ জুড়াতো, পাঠকরা এখানে তাদের সাক্ষাত লাভে তৃপ্তি বোধ করবে। মতবিনিময়ে নিজের স্বপ্ন ও আগ্রহের কথা বলবে। জানাবে নিজের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার কথা। প্রিয় লেখক থেকে অটোগ্রাফ নেবে। স্মৃতি হিসেবে তা পরম যত্নে সংরক্ষণ করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

শরিফুল ইসলাম বলেন, বইপ্রেমীদের আকর্ষণের আরেকটি উপায় হতে পারে মেলা থেকে কেনা বইয়ে বিশেষ কমিশন রাখা। পাঠক যেন নিজের পছন্দের বইটি অল্প মূল্যে সংগ্রহ করতে পারে। আরো থাকতে পারে প্রবীণ লেখকদের আলোচনা সভা। সাহিত্য পর্যালোচনা। কবিতা পাঠের আসর। থাকতে পারে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

তিনি আরো বলেন, এভাবে নানা উদ্যোগ-আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা এই বইমেলাকে গড়ে তুলতে পারি সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা হিসেবে। সমাজের নীতি-নৈতিকতা বিনির্মাণের উত্তম সহায়ক হিসেবে। এর মাধ্যমে আমরা ব্যক্তিমনের সর্বপ্রকার তুচ্ছতা ও সংকীর্ণতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি উন্নত ও উচ্চতর ভাবালোকে। একসময় দেশের বৃহত্তম গ্রন্থমেলা হিসেবে গড়ে উঠবে আমাদের ইসলামী বইমেলা।

যাত্রাবাড়ী মাহাদুশ শায়খ-এর শিক্ষার্থী নাঈম আল হাসান বলেন- অবশ্যই ইসলামী বইমেলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু ইসলামি ফাউন্ডেশনকে বিশিষ্টজনেরা গত কয়েকবছর অনেক কিছু সংস্করণ করতে বললেও তারা সেটা সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলা একাডেমীর মতো ইসলামিক ফাউন্ডেশন যেভাবে ইসলামী প্রকাশনীগুলার ট্রিট করা দরকার তারা সেভাবে পারছে না। এদিক থেকে তারা সম্পুর্ণ ব্যার্থ।

তিনি মনে করেন- আমাদের বড়রা যদি এই ইন্ডাস্ট্রির প্রতি নজর দিতো বা এগিয়ে আসতো তাহলে এই মেলা অনেকদূর অগ্রসর হতো।

তিনি বলেন, আরেকটা বিষয় আমরা দেখতে পাই, অমর একুশে বইমেলায় ছোট থেকে ছোট একটা স্টল, যারা নতুন প্রকাশনী তাদেরও প্রাতিষ্ঠানিক সরকারি অনুমোদনের কাগজপত্র থাকে‌। কিন্তু আমাদের ইসলামী প্রকাশনীগুলো এদিক থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন। নামি-দামি অনেক বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সরকারি অনুমোদন না থাকায় সেগুলো অবৈধ। যেমন- এবারের মেলায় অনেক ভালো ভালো প্রকাশনী স্টল পায়নি। পাঁচশোরও অধিক প্রকাশনী স্টল নেওয়ার জন্য আবেদন করে সেখানে স্টল বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ৫৫ টির মতো। আবার বই বের করতে যে অনুমোদনের প্রয়োজন হয় সেদিকেও তোয়াক্কা করছে না প্রকাশনীগুলো!

তিনি প্রত্যাশা করেন- বর্তমানে যেখানে মেলার আয়োজন হয় সেখানে স্থান সংকুলান হয় না। এজন্য বায়তুল মোকাররম থেকে সরিয়ে আরো বড় কোন যায়গায় আরো বৃহৎ আকারে এই মেলার আয়োজন করলে ভালো হবে। যেখানে আলাদা আলাদা কয়েকটি মঞ্চ থাকবে। যেমন- লেখক মঞ্চ, নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন স্টেজ, কবি-সাহিত্যিকদের জন্য আবৃত্তি ও সাহিত্য চর্চার মঞ্চ ইত্যাদি।

তিনি বলেন, এমনিতেই গুলিস্তান, বাইতুল মোকাররম, পল্টন এলাকা একটা ব্যস্ত যায়গা। তারউপর বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার সেখানে অনেক গেদারিং থাকে। এমনও দেখা যায়, অনেক ধার্মিক মহিলারা বই কিনতে এসে সাচ্ছন্দ্যে বই নিতে পারেন না। এই বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার!

নাঈম আল হাসান জানান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে থেকে নিয়ম করা আছে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের বাহিরে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের বই স্টলে রাখতে পারবে না। কিন্তু দেখা যাক যায়- কিছুকিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান যারা বইমেলায় স্টল পায়নি তাদের বই অবৈধভাবে স্টলে রাখা হয়। এটা অন্যায়।

মোটকথা- একটা নীতিমালা তৈরী করে নিয়ম-শৃঙ্খলার ভিতর না আসতে পারলে গত কয়েক বছরে ইসলামিক বইমেলার এই ইন্ডাস্ট্রি যেভাবে উত্থান হয়েছে তা অতিসত্বর ধস নামবে বলে আমি মনে করি।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।