Home ওপিনিয়ন ইউক্রেনের জন্য দুর্দশাই ডেকে আনছে আমেরিকার কৌশল!

ইউক্রেনের জন্য দুর্দশাই ডেকে আনছে আমেরিকার কৌশল!

ইউক্রেনের এই গোরস্তানে সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধে নিহতদের সমাহিত করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রক্ষেপণে অনুমান করা হয়েছে, এপর্যন্ত প্রায় এক লাখের বেশি ইউক্রেনীয় যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। ছবি- এশিয়া টাইমস।

ব্রান্ডন জে ওয়াইকার্ট: মালোচকরা বলেন, সুসংহত কৌশলের অভাবে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়াসহ মুসলিম দেশগুলোতে আমেরিকার পরিচালিত ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’ ব্যর্থতায় রূপ নিয়েছে।

১৮ শতকের প্রুশিয়ান সমরবিদ কার্ল ফন ক্লোজোউইটজ বলে গেছেন, ‘যুদ্ধ হলো অন্য উপায়ে রাজনীতিরই সম্প্রসারিত অংশ’। তাই যুদ্ধ রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয় কখনোই। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, যুদ্ধ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনে রাষ্ট্র বা অরাষ্ট্রীয় শক্তির সহিংস পদক্ষেপ।

এ কারণেই সামরিক শক্তি প্রয়োগের আগে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তার সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। আবার, নির্ভরযোগ্য উপায় থাকতে হবে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত এসব রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে। অর্থাৎ এজন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং সম্পদ, শক্তি নিয়োজিত করার সক্ষমতাও থাকতে হবে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো—সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেন যুদ্ধের রাজনৈতিক লক্ষ্যকে স্থির রাখে। মাঝপথে তা বদলানো যাবে না। কিন্তু গত ৩০ বছরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আওতায় করা সামরিক সব হস্তক্ষেপ রূপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতায়, দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট গেটস যাকে ‘মিশন ক্রিপ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ যেন ফুটবল ম্যাচের মাঝখানে গোলপোস্ট বদলানো, যা শেষপর্যন্ত জয়কে অসম্ভব করে তোলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তে বা ১৯৪৫ সালের পর থেকে অনেক দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এসেছে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায়। এতে মার্কিন সেনাবাহিনী গৌরব হারিয়েছে। একইসঙ্গে এটা তাদের চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো বড় হুমকি মোকাবিলার প্রস্তুতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

আফগানিস্তানে সুদীর্ঘ পরাজয়

সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ হয়েছে আফগানিস্তানে। দেশটি হয়ে উঠেছিল তালেবান ও তাদের মিত্র আল কায়েদার মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাঁটি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলার পর তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রাথমিক লক্ষ্যই হয় আফগান ভূখণ্ড।

মার্কিন বিমান বাহিনীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল আফগানিস্তানের আকাশে। বিমানশক্তির সহায়তায় মার্কিন স্পেশাল ফোর্স, সিআইএ চর ও স্থানীয় উপজাতি নেতারা একজোট হয়ে তালেবান সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটায়। আফগানিস্তান দখলের মাত্র দুই মাসের—অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর—মধ্যেই সেখানে আল কায়েদার শক্ত অবস্থানকেও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু ডিসেম্বরে মার্কিনীদের পরিকল্পনায় খামখেয়ালি না থাকলে মৃত্যু বা গ্রেপ্তার এড়িয়ে তোরাবোরা পাহাড় থেকে পালাতে পারতেন না আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন। আর তার মধ্যে দিয়েই সফলভাবে শেষ হতে পারত আফগানিস্তানে মার্কিন মিশন।

তবে ২০০২ সালের বসন্তেও রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণ হচ্ছিল। এ সময়ে মার্কিন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী, আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদীদের নেটওয়ার্ক ধবংস করে মার্কিন বাহিনী। ৯/১১-এর হামলার পরিকল্পনাকারীদেরও আটক করে।

এখানেও শেষ হতে পারত সামরিক অভিযান। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্য মাঝপথে নির্ধারণ করা হলো—আফগানিস্তানের পুনর্গঠন, আর সেখানে প্রতিষ্ঠিত পুতুল সরকারকে টিকিয়ে রাখা। ফলে দুই দশকব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়ায় আমেরিকা। সেনাদের প্রাণহানি, অর্থ, অস্ত্রের বিপুল অপচয় শেষে সেখান থেকে পরাজিত, রিক্ত হস্তেই ফিরতে হয় তাদের।

আফগানিস্তান, যে দেশকে বলা হয় ‘সাম্রাজ্যের গোরস্থান’—সেখানে কেন এই শক্তিক্ষয়? কী-ই বা ছিল তার চূড়ান্ত লক্ষ্য? প্রকৃতপক্ষে সুদৃঢ় কৌশলের অভাবেই (যা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন দিয়ে নির্ধারিত) আমেরিকাকে অপদস্থ হতে হয়েছে।

ইরাক: নির্বোধের স্বর্গ

ইরাকে সামরিক অভিযান পরিচালনার লক্ষ্যও ছিল স্পষ্ট। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন নিশ্চিত ছিল, সাদ্দাম হোসেন গোপনে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (ডব্লিউএমডি) তৈরির কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। আর তার সাথে যোগাযোগ আছে আল কায়েদার।

আমেরিকা এই যোগসাজশকে বলে সন্ত্রাসের উর্বর ক্ষেত্র। আর ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পর খুব শিগগিরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সাদ্দামের বিরুদ্ধে বুশ প্রশাসনের এ দুটি অভিযোগই ছিল ভিত্তিহীন, বানোয়াট।

সত্যটা উপলদ্ধি করার পরও ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদরা সেখানে মার্কিন বাহিনীকে রাখার সিদ্ধান্ত নেন, যারা ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য ইরাকিদের কাছে ঘৃণিত হয়ে উঠেছিল। তাই বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের লক্ষ্য করে হামলা অব্যাহত রাখে। এরমধ্যেই বুশ প্রশাসন সাদ্দামকে অপসারণ ও তার সাথে আল কায়েদার কথিত সংযোগ বিনষ্ট করার লক্ষ্য পরিবর্তন করে, সেখানে যোগ করে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের লক্ষ্য।

এক কথায়, ইরাক দেখেছে আমেরিকান গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত। একটি স্বাধীন দেশে মিথ্যে অভিযোগে অবলীলায় চালানো হয় আগ্রাসন। ইরাকের আপামর জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ মোকাবিলা করার মতো সেনাসংখ্যা না নিয়ে করা হয় এ অভিযান। সুস্পষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য না থাকায় শেষপর্যন্ত ইরান ও আইএসআইএ- এর ভিত্তি শক্তিশালী করেই মার্কিন বাহিনীকে রণে ভঙ্গ দিতে হয়।

ইউক্রেন নীতি নিয়েও অনিশ্চিত, ঘোরের বশে আমেরিকা

মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলোতে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে চরম ব্যর্থতার পর মার্কিনীরা এখন তাদের ব্যর্থতার ঝাঁপি নিয়ে হাজির হয়েছে ইউক্রেনে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। তখন থেকেই ইউক্রেনকে অস্ত্রসহ সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে ওয়াশিংটন।

এখানে রাজনৈতিক লক্ষ্য কী? ২০২২ সালে মনে করা হচ্ছিল, পশ্চিম ইউক্রেন যেন রাশিয়ার দখলে চলে না যায়, সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্ররা এ সহায়তা দিচ্ছে। এই কৌশলকে বাস্তবসম্মত মনে হয়, আর তা সফলও হয়েছে। পশ্চিমাদের সহায়তা ও ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধের মুখে এক লাখ ৬০ হাজার রুশ সেনাকে কিয়েভের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে হয়েছে।

কিয়েভ বিপদমুক্ত হওয়ায় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির সরকারের অস্তিত্ব রক্ষা পায়। এরপর শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়াটাই হতো সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। শান্তি প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনের রুশভাষী পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা ও ক্রিমিয়া ছেড়ে দিয়ে পশ্চিম ইউক্রেনকে মুক্ত রাখার উদ্যোগ নেওয়া যেত।

অথচ মার্কিনীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণ (পশ্চিম ইউক্রেনের নিরাপত্তা) হওয়ার সাথে সাথেই আরও উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে। অঞ্চলভিত্তিক প্রতিরোধের বাস্তবসম্মত প্রতিরোধ থেকে সরে এসে দখলীকৃত সব এলাকা পুনরুদ্ধারের মতো কৌশল নিতে ইউক্রেনকে চাপ দিতে থাকে। পূর্ব ইউরোপ ও ক্রিমিয়ায় শক্তিশালী রুশ অবস্থানের কারণে যে কৌশল ইউক্রেনের সাধ্যের পক্ষে অচিন্তনীয়।

সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং রাশিয়ান ফেডারেশনকে ভেঙে ফেলার বিষয়েও প্রকাশ্যে আলোচনা করছেন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ। অথচ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া এমনটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবু ওয়াশিংটনে কল্পনার ঘোর যেন কাটছেই না, আর কৌশলগতভাবে ইউক্রেনকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য করা হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন-

মার্কিনীদের মতো কৌশলগত ‘মূর্খ’দের পরামর্শ মেনে ইউক্রেন যা করবে, তার পরিণতিতে দেশটি আরো রিক্ত হবে, পরিণত হবে ধবংসস্তূপে। পশ্চিমাদের কোষাগার ও অস্ত্রের মজুতও নিঃশেষ হতেই থাকবে এবং তারা রাশিয়ার পাল্টা আক্রমণ সামলানোর পক্ষে বেশ দুর্বল হয়ে পড়বে। বর্তমানে ইউক্রেন নিয়ে এমনটাই করা হচ্ছে।

ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক আকাশকুসুম লক্ষ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ে ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী রাশিয়ার সাথে এমন যুদ্ধে জড়িয়েছে যেখানে তাদের বিজয় অসম্ভব। অন্যদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বৃহত্তর যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার দিক থেকেও সক্ষমতা হারাচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়া।

ওয়াশিংটনের আইনপ্রণেতারা শিশুসুলভ আচরণে মত্ত। এ সময় যদি সেখানে সত্যিকার অর্থে কোনো ‘পূর্ণবয়স্ক’ থাকতেন, বা সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে হয়তো রুশো-ইউক্রেন যুদ্ধ এড়ানো যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো ওয়াশিংটনের প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাধরেরা জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে আত্মসচেতন নন।

ক্ষমতার এই বরপুত্ররা তাদের যুদ্ধ দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দিচ্ছেন ইউক্রেনের নিরাপরাধ সন্তানদের। রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের দিকেই টেনে নিচ্ছেন তারা পরিস্থিতিকে, যে যুদ্ধে আমেরিকার তরুণদেরও রক্ত ঝরবে।

কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে দশকের পর দশক ধরে একের পর এক ভুল করে চলেছে ওয়াশিংটনের শাসকগোষ্ঠী। পররাষ্ট্রনীতির প্রতিটি ব্যর্থতার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ব্যবস্থার শীর্ষস্থান থেকে আমেরিকারও পতন হচ্ছে। এই পতন কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারে না।

আমেরিকার শক্তিক্ষয় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে দেবে। তাই সময় থাকতেই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে ওয়াশিংটনকে।

বর্তমান কৌশল অব্যাহত থাকলে হয় ইউক্রেনকে কোনো জাদুকরি কৌশলে রাশিয়াকে পরাজিত করতে হবে, নাহলে রাশিয়া দেশটিকে ধূলিসাৎ করে দেবে। এতে ইউরোপে আমেরিকার কৌশলগত অবস্থান এবং ন্যাটো জোটের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে। এক মেরুর বদলে তৈরি হবে বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা, নতুন শক্তিগুলো সরাসরি আমেরিকার বিরোধিতা করবে।

সূত্র- এশিয়া টাইমস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।