Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ২০০ বছরের গৌরবময় ঐতিহ্যের খুলনার বড় বাজার এখন যে রকম চলছে

২০০ বছরের গৌরবময় ঐতিহ্যের খুলনার বড় বাজার এখন যে রকম চলছে

অনিন্দ্য হক: প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন খুলনা মহানগরীর ‘বড় বাজার’। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্র এটি। এখানে প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ টাকার পণ্য সামগ্রী বেচাকেনা হয়। মূলত বড় বাজারে পাইকারি কেনাবেচাই হয় বেশি। এ অঞ্চলের বিভিন্ন শহর, বন্দর ও ছোট-বড় হাট-বাজারের ব্যবসায়ীরা বড় বাজার থেকে তাদের চাহিদামত মালামাল কিনে থাকেন। এ বাজারে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। খুলনা মহানগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের পাড় ঘেঁষে ওয়েস্ট মেকড রোড, ভৈরব স্ট্র্যান্ড রোড, কালীবাড়ি রোড, কেডি ঘোষ রোড, ক্লে রোড, জিকজ্যাক রোড, স্যার ইকবাল রোডের একাংশ ও স্টেশন রোড নিয়ে বড় বাজারের বিশাল অবস্থান। তবে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাকালে বড় বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শহর হিসাবে বিখ্যাত হওয়ার আগে খুলনার পরিচিতি ছিল ‘চার্লিরহাট’ বা সাহেবের হাট নামে। তখন বড় বাজারের নাম ছিল ‘চার্লিগঞ্জ’ বা সাহেবের হাট। নীল কুঠিয়াল চার্লস এ বাজার প্রতিষ্ঠা করার কারণে তার নামেই নামকরণ করা হয় চার্লিগঞ্জ।

এক সময় খুলনা ছিল যশোর জেলার অন্তর্গত। ১৮৪২ সালে খুলনাকে নয়াবাদ থানা থেকে মহাকুমায় উন্নীত করা হয়। এ সময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে ভৈরব নদের পাড়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বাজার। এক পর্যায়ে মহাকুমা প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পর ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল নতুন জেলার নোটিফিকেশন করা হয়। ওই বছরের ১ জুন থেকে খুলনা জেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এরপর থেকেই খুলনার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ফলে জেলা শহর খুলনায় লোকসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। বাড়ে বড় বাজারের পরিধিও। ১৮৮০ ও ১৮৮৪ সালে স্টীমার, রেল স্টেশন ও পৌরসভা চালু হলে বড় বাজার হয়ে ওঠে জমজমাট। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নতুন নতুন ব্যবসায়ীর আগমনে এ বাজার রূপলাভ করে বড় ব্যবসা কেন্দ্রে। বরিশাল, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামসহ দূর-দূরান্ত থেকেও ব্যবসায়ীরা আসে এ বাজারে। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আসে মাড়োয়ারীরা। মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা এ বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলে বিভিন্ন দোকানপাট, আড়ৎ, গুদাম প্রভৃতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ধীরে ধীরে ‘বড় বাজার’ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কেনাবেচার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

আরও পড়তে পারেন-

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত মাড়োয়ারীরা বড় বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর মাড়োয়ারীরা আস্তে আস্তে এ বাজার থেকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিতে থাকে। এ সময় বড় বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে অল্প সময়ের মধ্যে এ শূণ্য স্থান পূরণ করে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা। ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে মংলা বন্দরের (চালনা বন্দর) গোড়া পত্তনের পর বড় বাজার আবার তার পূর্ণ যৌবন ফিরে পায়। মংলা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি পণ্য বড় বাজারের পাশেই খালাস করা হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এ বাজার থেকে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নেয়। সে সময় বড় বাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যে আবারো শূণ্যতা দেখা দেয়। তবে দ্রুত বাঙ্গালি ব্যবসায়ীরা এই শূণ্য স্থান পূরণ করতে সক্ষম হয়।

গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ‘বড় বাজারে’ আবারো ভাটার টান শুরু হয়। চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অত্যাচার-নির্যাতনে অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়ে অন্যত্র ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। তাছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ নৌপথ বন্ধ হয়ে যাওয়া, মংলা বন্দরের কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়া এবং নগরীর অধিকাংশ শিল্প কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঢেউ বড় বাজারে এসেও লাগে। তবে এখনও শত বাধা মোকাবেলা করে পাইকারি মোকাম হিসেবে খুলনার বড় বাজার এখনো তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

খুলনা বড় বাজারের চাল ব্যবসায়ী মেসার্স নাসির অ্যান্ড ব্রাদার্সের সত্ত্বাধিকারী রথিন সাহা বলেন, বাজারের সড়কগুলো খুবই সরু। এ সরু সড়কের অর্ধেক অংশ দখল করে অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছেন। ফলে প্রতিনিয়ত রিকশা ও ঠেলাগাড়ির জটলা সৃষ্টি হয়। বাজারে ক্রেতাদের আসতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেক সময় চাহিদা অনুযায়ী মালামাল পরিবহন করা যায় না।

মেসার্স আলাউদ্দিন ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী আলাউদ্দিন বলেন, বড় বাজার আসলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। বৈদ্যুতিক তার যত্রতত্র ঝুলে পড়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে অনেকে ব্যবসা পরিচালনা করছে। বাজারে কোনো শৃঙ্খলা নেই। এতে প্রত্যশা অনুযায়ী বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না। তাই সংশ্লিষ্টদের উচিত ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন করা।

বড় বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মেসার্স মুনীর আহমেদ অ্যান্ড ব্রাদার্সের সত্ত্বাধিকারী, খুলনা ধান চাল বণিক সমিতির সভাপতি ও খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি মো. মুনীর আহমেদ বলেন, বর্তমানে বড় বাজারের ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। করোনার আগে বড় বাজারে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হতো। করোনার কারণে বর্তমানে সেই ব্যবসা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তিনি বলেন, সরু রাস্তার কারণে বড় বাজারে মানুষের চলাফেরায় খুব অসুবিধা। ভৈরব স্ট্র্যান্ড রোড নদীতে ভেঙ্গে গেছে। ওয়েস্ট মেকড রোড খুবই সরু। কদমতলা থেকে মহেন্দ্রদাশের মোড় পর্যন্ত খুব খারাপ অবস্থা। দ্রুত এ সব সড়ক সংস্কার করা জরুরি।

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) ট্রেড লাইসেন্স শাখার সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট শেখ হুমায়ুন কবীর বলেন, বড় বাজারে ৩ হাজার ৬৫০টি লাইসেন্সকৃত ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। গত অর্থ বছরে (২০১৯-২০) ট্রেড লাইলান্সের মাধ্যমে খুলনা সিটি করপোরেশন নগরী থেকে ৫ কোটি ৮৩ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬১ টাকা আয় করেছে। তবে ট্রেড লাইলান্সের মাধ্যমে বড় বাজার থেকে কত টাকা আয় হয়েছে আলাদাভাবে সে হিসেব কেসিসির কাছে নেই।

কেসিসির বাজার সুপার মো. সেলিমুর রহমান বলেন, গত অর্থ বছরে বড় বাজারের ফুটপাতের দোকানপাট থেকে ১৮ লাখ ২৮ হাজার ৪০৬ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। 

তিনি বলেন, বড় বাজারের রাস্তাঘাট সংস্কার, লাইট, কনভারজেন্সিসহ সব নাগরিক সেবা কেসিসি দিয়ে থাকলেও বড় বড় কর-খাজনা নেয় বিআইডব্লিউটিএ, জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, রোড অ্যান হাইওয়েজ (সওজ), রেলের কানুনগো– এই সব সংস্থা।

এ ব্যাপারে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) প্রধান প্রকৌশলী এজাজ মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, আপাতত বড় বাজার উন্নয়নে কোনো প্রকল্প নেই।

কেসিসির স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামসুজ্জামান মিয়া স্বপন বলেন, বড় বাজারের ওয়েস্ট মেকড রোডটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। ২০১০ সালে এই সড়কটির দু’পাশে চারফুট চওড়া করা হয়। বর্তমানে ওয়েস্ট মেকড রোডসহ বড় বাজারের সংস্কার করতে গেলে বহু ছোট-বড় দোকানপাট উচ্ছেদ করতে হবে। এতে ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া এই বাজারটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ঐতিহ্য। তাই বাজারটির সংস্কার করার চেয়ে আমরা বাজারটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই। সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।